সংসদে বিএনপি ছাড়া বিরোধী কেউ নেই: রুমিন ফারহানা
>একাদশ সংসদের মেয়াদ ছয় মাস ছুঁইছুঁই। ইতিমধ্যে বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে। বিএনপি থেকে (সংরক্ষিত আসনে) প্রথম সংসদে এসেছেন রুমিন ফারহানা। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। সংসদ ও রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: সংসদকে অবৈধ বলে বিএনপি বিলম্বে সংসদে গেছে। এই সিদ্ধান্ত এখনো সঠিক মনে হলে সেটা কেন?
রুমিন ফারহানা: সংসদে না যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনটি আমাদের নেতা-কর্মীদের হতবিহ্বল করে রেখেছিল। এরপর আমরা ভেবেছি, অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর যেভাবে জুলুম চলছে, সেসব তুলে ধরতে সংসদকে আমরা একটি ফোরাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি কি না। সুতরাং বিএনপির সংসদে যোগদানকে সেই আলোকেই দেখতে হবে।
প্রথম আলো: সংসদে গিয়ে আপনার দল বা আপনি কী অর্জন করেছেন, নির্দিষ্ট করে বলা যায় কি না?
রুমিন ফারহানা: আমি শুধুই বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছি। সুতরাং সংসদীয় কার্যক্রম সম্পর্কে আমার মন্তব্য করা খুব আগাম হয়ে যাবে হয়তো। তারপরও আমি বলতে চাই, সংসদে যাওয়ার আগে সরকারের তরফে আমরা একটা আশ্বাস পেয়েছিলাম যে আমাদের সংখ্যা যা-ই হোক, পর্যাপ্ত সময়-সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। প্রথম দিনে আমি ১০ সেকেন্ডও কথা বলতে পারিনি শান্তিতে। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, সময় বরাদ্দের বিষয়ের পুরোটাই মাননীয় স্পিকারের একচ্ছত্র অধিকার। তিনি যাঁকে খুশি সময় দেবেন এবং চাইলে তিনি এক মিনিট সময় না-ও দিতে পারেন। তবে এ কথাও বলব, আমরা সবাই মানি যে ওয়েস্ট মিনস্টার মডেলে আমরা বাহাত্তরে সংবিধান তৈরি করেছিলাম। আর ব্রিটেনের স্পিকার অধিকাংশ বিতর্কে যাতে ৪ থেকে ৫ মিনিট সময় দেন এবং বাধা দিলে ‘ইনজুরি টাইম’ যুক্ত করতে পারেন, সেই বিধান প্রসিডিউর কমিটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
প্রথম আলো: এ পর্যন্ত আপনাদের কতগুলো শব্দ অসংসদীয় বিবেচনায় এক্সপাঞ্জ করা হয়েছে? রেকর্ড দেখেছেন।
রুমিন ফারহানা: আমি যখন বলেছি সংসদটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নয়, ডেপুটি স্পিকার হয়তো এসব কথাই এক্সপাঞ্জ করে থাকবেন। তবে আমি নিশ্চিত নই। কারণ, ওই দিন সংসদে এত বেশি হট্টগোল হয়েছিল—আমার বক্তব্যে গুম-খুনের কথা ছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা ছিল। আমি সেই রেকর্ড দেখতে পাইনি। পরে অবশ্য যে স্ক্রিপ্ট আমার কাছে পাঠানে হয়েছে, সেখানে এক্সপাঞ্জ দেখিনি। কিছুই এক্সপাঞ্জ হওয়া উচিত নয়। সাংসদদের সাংস্কৃতিক মানের ডকুমেন্টেশন দরকার।
প্রথম আলো: আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আপনার দল এবং সার্বিকভাবে সাংসদদের চলমান প্র্যাকটিস সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
রুমিন ফারহানা: আমি মনে করি, সাংসদেরা চাইলে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় একটা ভূমিকা পালন করতে পারেন। আইনের সংযোজন-বিয়োজন বা পরিবর্তন চাইলে তাঁরা করতে পারেন। আমি দুটো বিল পাসের প্রক্রিয়া দেখেছি, যেখানে সংশোধনীগুলোর সবটাই বিরোধী দলের দিক থেকে এসেছে। একটি সংশোধনীও সরকারি দল থেকে প্রস্তাব করা হয়নি। মনে হচ্ছে, কোনো আইন সংশোধনে প্রস্তাব আনার দায়িত্ব শুধুই বিরোধী দলের কাঁধে বর্তায়।
প্রথম আলো: বাজেট প্রস্তাবের পরে সরকারি দল থেকেও সমালোচনা এসেছে। সংসদের বাইরে নাগরিক সমাজ থেকেও নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বাজেট পাসের পরে আপনার মূল্যায়ন কী? কতটা সরকার নিতে পারল?
রুমিন ফারহানা: আমার বাজেট বক্তৃতার বিষয়টিই ছিল শোষণমূলক অর্থনীতি নিয়ে। যে অর্থনীতি সাধারণ জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে একটি বিশেষ শ্রেণিকে আরও বেশি ধনী হতে সাহায্য করে। কল্যাণ রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ, সেটা আর যা-ই হোক কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের ইঙ্গিত করে না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে আমি দেখিয়েছি, এসব খাতে বরাদ্দ অত্যন্ত কম। বাজেট পাসের পরে দেখেছি, এসব উদ্বেগের কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি সঞ্চয়পত্রের সুদ নিয়ে সরকারি দল, এমনকি মাননীয় সংসদ নেত্রীকেও কথা বলতে শুনেছি, কিন্তু সেখানেও পরিবর্তন পেলাম না। সব থেকে পরিহাস হলো, বিচার বিভাগেই সব থেকে কম বরাদ্দ এসেছে। একজন সাংসদ দীর্ঘ আলাপ করেছেন, সেটারও কোনো ছাপ পেলাম না। মোটকথা, যা প্রস্তাব করা হয়েছিল, মোটাদাগে সেটাই পাস হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: সংসদীয় কমিটি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? সেখানে আপনার দল বা আপনার অগ্রাধিকার কী থাকবে?
রুমিন ফারহানা: আমি গত সপ্তাহেই একটি কমিটিতে সবে ঢুকেছি। এটা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখনো কোনো বৈঠকে যোগ দিইনি। তবে আমি মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে বেশি জোর দিতে আগ্রহী। সাম্প্রতিক কালে বিচার বিভাগের নানা বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠছে। আমি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করব। বিশেষ করে, ৩০ লাখের বেশি মামলার জট নিরসন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পূর্ণতা দেওয়া। আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলব, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাছেই ন্যস্ত থাকা উচিত। এ ছাড়া অবিলম্বে আদালত অবমাননা ও ডিজিটাল আইনে যথাযথ সংশোধনী আনার দিকে আমি মনোযোগী হতে চাই।
প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী হয়তো শিগগির ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ চাইবেন। আপনার দল কী চাইবে?
রুমিন ফারহানা: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চাইলে চতুর্থ সংশোধনীর মতোই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এনেছিলেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাইলে বিচারপতিদের নিয়োগ ও অপসারণের পুরোটাই বিচারপতিদের হাতেই থাকা উচিত। আমরা চাই রায়টি তার পূর্ণ পর্যবেক্ষণসহ টিকে থাক।
প্রথম আলো: নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক ক্ষমতার চর্চা করছেন। যদিও মোবাইল কোর্ট আইনকে হাইকোর্ট অসাংবিধানিক বলেছেন। এখন ডিসিরা অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করছেন।
রুমিন ফারহানা: তাঁদের এই দাবি সম্পূর্ণরূপে সংবিধানের বাইরে। এটা ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতিকে আঘাত করছে।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ রাখা হলেও ব্যতিক্রম হলো জেলা প্রশাসন। এর ওপরে জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার জেলা পরিষদও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নয়।
রুমিন ফারহানা: উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫ ধারায় সাংসদদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগের একটা সুযোগ করে দেওয়া আছে। এমনটি কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সত্যি বলতে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতি আগ্রহী হয়েই বেশির ভাগ মানুষ সাংসদ হতে চান বলেই, সাংসদ হওয়ার জন্য শিক্ষার যে মান এবং রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার, সেই মানের মানুষ খুব কম আসে।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে আপনারা সংসদে সরব। প্যারোলের দরখাস্ত কেন নয়?
রুমিন ফারহানা: প্যারোল চাইলে তিনি অনেক আগেই মুক্তি পেতে পারতেন। তাঁর মামলার যা মেরিট, বয়স এবং নারী হওয়ার কারণে তিনি তাৎক্ষণিক জামিন লাভের দাবিদার। কেন আটকে আছে, তা বাংলার ১৬ কোটি মানুষ জানে।
প্রথম আলো: এরশাদের মৃত্যুর পর বিরোধীদলীয় নেতা
কে হবেন?
রুমিন ফারহানা: আমি বলেছিলাম, আমি এমন এক সংসদে বসেছি যে কোনটা সরকারি কোনটা বিরোধী দল, তা বুঝতে পারি না। আমরা বিএনপির সাতজন ছাড়া সরকারের সত্যিকার বিরোধিতাকারী কাউকে দেখি না। সংসদে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার বিরাট ঘাটতি চলছে। জাপায় দুটো ধারা আছে। এরশাদের মৃত্যুর পরে কী হয়, সেটা দেখার বিষয়। তবে সংসদ গঠনকালে বিএনপি সংসদে ছিল না। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি বলছে, স্পিকারই নির্ধারণ করবেন কে হবেন বিরোধী দলের নেতা। সুতরাং এখানে সংখ্যার ওপর জোর দেওয়ার বিষয় নেই। তাই মাননীয় স্পিকার কী করবেন, সেটা তাঁর এখতিয়ার, কিন্তু মানুষ দেখবে বিএনপির উপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় নেতা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি কোন দলকে বেছে নেন। বিএনপিকে বেছে নিলে তিনি যে দেশের মানুষের সামনে একটা উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রথম আলো: তারেক রহমান স্বেচ্ছানির্বাসিত। খালেদা জিয়া বন্দী। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকলে বিএনপিকে নিয়ে আগামী সংসদ গঠনে মানুষ কেন আশাবাদী হবে?
রুমিন ফারহানা: ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসিত সত্য। প্রতি মুহূর্তে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন। স্কাইপির মাধ্যমে জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন। উপরন্তু আমাদের স্থায়ী কমিটিসহ নানা স্তরের কমিটি ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। সুতরাং, এতগুলো স্তর পার হয়ে চলমান দলীয় কার্যক্রমে আমি কোনো অসুবিধা দেখি না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রুমিন ফারহানা: ধন্যবাদ।