মিন্নি কাদের স্বস্তি দিচ্ছে?
মানুষ মাত্রই স্বস্তি খোঁজে। সে গরমই হোক, আর অতিবৃষ্টি। বেঁচে থাকার প্রাথমিক চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ নেমে পড়ে স্বস্তির খোঁজে। সবাই নিরাপদ বেষ্টনীতে থাকতে চায়। এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই কোনো ঘটনায় কোনো এক শ্রেণির মানুষ জেরবার হয়ে উঠলে, তারা পথ খুঁজতে থাকে এ থেকে যেকোনো মূল্যে বের হতে। অনেকটা ওই প্রচলিত কথার মতো খড়কুটো আঁকড়ে হলেও ডাঙায় উঠতে চায় তারা। কারণ ডাঙাতেই তাদের নিরন্তর স্বস্তি। পায়ের তলায় মাটি কে না পেতে চায়।
এই স্বস্তির প্রসঙ্গটি তুলতে হচ্ছে সাম্প্রতিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। এই একটি নামই যথেষ্ট ঘটনাটির বর্ণনার জন্য। দেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এখন এটি। আলোচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক অবশ্য। মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফকে যেভাবে প্রকাশ্য জনবহুল রাস্তায় হত্যা করা হয়েছে, তা এই ঘটনাকে সবচেয়ে আলোচিত জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অঘটনবহুল এ দেশে মিন্নি নামটি তো মুছেও যাওয়ার কথা। কারণ, এরপর আরও বহু ঘটনা ঘটে গেছে।
গত ২৬ জুনের ওই হত্যাকাণ্ডের পর, হত্যাকারী নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে অদ্ভুত গুজব, সর্বশেষ নেত্রকোনায় বস্তাবন্দী শিশুর কাটা মাথা নিয়ে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যুসহ আরও অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এর মধ্যে জুলাইয়েই অন্তত দুজন বাবার বিরুদ্ধে শিশু সন্তান ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এর যেকোনো একটি ঘটনাই মিন্নিকে মুছে দিতে পারত। কিন্তু দেয়নি। কারণ, স্বস্তি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায় মিন্নির আলোচিত থাকার সঙ্গে স্বস্তির সম্পর্কটি আসলে কী? একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মিন্নি প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন স্বামী রিফাত শরীফকে বাঁচানোর চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে, যখন চারপাশের অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি হত্যাদৃশ্য দেখছিল। সেই সাহসের জন্যই তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন। কিন্তু ঘটনার স্রোতে তাও তো মুছে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুছল না। কেন? কারণ, নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর মিন্নি ধীরে ধীরে উদ্ধারকারী থেকে হত্যা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিই রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, যাকে আবার তাঁর বাবা মোজাম্মেল হোসেন দাবি করছেন ‘জোরজবরদস্তিমূলক’ বলে। এই জবানবন্দি ও তা নিয়ে তৈরি হওয়া সংশয়ের মধ্যে কোনটি জোরালো এবং সত্য তা নির্ধারণ করবেন আদালত। শেষ সিদ্ধান্তটি সেখান থেকেই আসবে—এটাই প্রত্যাশা সবার। সে কথায় বরং আমরা না যাই।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, মিন্নিকে নিয়ে এ বাড়তি কচকচানিটি তবে কেন? এটি করতে হচ্ছে, কারণ মিন্নি একটি শ্রেণিকে বিরাট স্বস্তি দিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। আবারও স্বস্তির প্রসঙ্গ এল। ঘুরেফিরেই আসবে। মিন্নি রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন—এমন প্রশ্ন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আলোচনা যেদিকে ঘুরে গেল, তার প্রকরণের কারণেই স্বস্তি-অস্বস্তির প্রশ্নটি আসছে। অভিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হত্যাদৃশ্যে দাঁড়ানো নির্লিপ্ত মানুষ ও মানসিকভাবে তাদের সহযাত্রী সবাইকে স্বস্তি দিলেন মিন্নি। তাঁরা বলতে পারলেন যে, ‘দেখেছ কী অভিনয়?’ এই কথা দিয়ে তাঁরা নাটকের নির্দোষ দর্শক হওয়ার ফুরসত পেলেন। স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। তিনি স্বস্তি দিলেন আরও অনেককে অজ্ঞাতেই।
কতজনকে স্বস্তি দিলেন? এ প্রশ্নটির মীমাংসার আগে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। মূলত বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য নিয়েই এই সামগ্রিক তথ্যটি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই পরিসংখ্যান বলছে, আমরা মূলত একটি ধর্ষক অধ্যুষিত সমাজে বাস করছি। ধর্ষকের তালিকায় কে নেই? সবাই আছে।
এই একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বেশ অস্বস্তি তৈরি করেছিল সমাজের পুরুষ শ্রেণিটির মধ্যে। নিজের আপনজনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, তারা এমনকি এর বিরুদ্ধে অবস্থানও নিচ্ছিল। ধর্ষণের মতো ঘটনাতেও এ দেশের পুরুষদের অধিকাংশেরই প্রতিবাদী হতে নিজের আপনজনের মুখটি মনে করা প্রয়োজন হয়। কারণ, নারীকে নারী হিসেবে নয়, কোনো সম্পর্ক-সূত্রে বেঁধেই সে একমাত্র সম্মান জানাতে প্রস্তুত থাকে। তো এই সম্পর্কে আবদ্ধ নারীদের যখন সে দেখল ঝুঁকিতে আছে, পুরুষের নির্যাতনস্পৃহা কোনো বয়স, স্থান, কাল, পাত্র মানছে না, তখন সে প্রতিবাদী হতে চাইল। এমনকি ধর্ষককে নিয়ে ‘ক্রসফায়ার’–এ যাওয়ার পক্ষেও অবস্থান নিল একটি পক্ষ।
এর মধ্যেও কেউ কেউ ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়ল না অবশ্য। কিন্তু চারপাশে ঘটনা এত বেশি ঘটতে থাকল যে, তাদের কণ্ঠ অনেকটা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। সার্বিকভাবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্লাবন এ দেশের পুরুষ সমাজকে এক ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে এনে ফেলল। এই পরিস্থিতি থেকেই মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন মিন্নি।
মিন্নি প্রথমে অস্বস্তি হিসেবেই সামনে হাজির হয়েছিলেন। অসংখ্য মানুষের মধ্যে এই একটি নারী চরিত্রই শুধু রিফাতকে বাঁচাতে সচেষ্ট ছিল বলে, সবাই মিলে তাঁর প্রশংসা করলেও আদতে ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে গেল। কুঁকড়ে যে গেল, তা স্পষ্ট হলো মিন্নির বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। নানা দিক থেকে অগণিত আঙুল তাঁর দিকে তাক হলো। বলতে থাকল, ‘দেখেছ, আগেই বলেছিলাম। এমন কিছু আছেই।’
মিন্নি এককথায় সমাজের পুরো পুরুষ মানসটিকেই নগ্ন করে দিয়েছে বলা যায়। অপরাধ ও নির্যাতনের নানাবিধ ঘটনার সঙ্গে বারবার একজন পুরুষের নাম উঠে আসার মধ্য দিয়ে পুরুষের গায়েই একটি ‘নির্যাতক’ ট্যাগ লেগে যাচ্ছিল। বিশেষত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পুরুষের বিরুদ্ধেই পুরুষ কথা বলতে বাধ্য হলো। অনেক পুরুষই নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে এমনটা করল। ফলে যেই মাত্র মিন্নির ঘটনাটি সামনে এল, সঙ্গে সঙ্গে তারা একযোগে তাঁকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে নেমে পড়ল। এখানে মিন্নির বদলে অন্য যেকোনো নারীর নাম উঠে এলেও একই ঘটনা ঘটত। বিন্দুমাত্র ত্রুটির সুযোগ নিয়ে তাঁর ব্যবচ্ছেদ হতো। কারণ, ‘নির্যাতক’ ট্যাগ লাগা পুরুষদের একটু স্বস্তি চাই। মিন্নি শেষ পর্যন্ত কতটা দোষী, তা নির্ধারণের দায় আদালতের—তা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই তাঁর ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পুরো সমাজ যে অবস্থান নিয়েছে, তা ভাববার দাবি রাখে।
মিন্নি কি শুধু সমাজের পুরুষ শ্রেণিটিকেই স্বস্তি দিয়েছে? না সে রাষ্ট্রকেও স্বস্তি দিয়েছে। অবশ্য রাষ্ট্র নিজেই স্বস্তির পথটি খুঁজে বের করেছে বলা যায়। রাষ্ট্র প্রথমে রিফাত হত্যার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিদান হিসেবে হাজির হয়েছে, বরাবরের মতোই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দটি। এই ঘটনায় এই শব্দের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কারণ, নয়ন বন্ড ও তাদের দলটির ক্ষমতার উৎস হিসেবে যার বা যাদের নাম এসেছিল, তারা ক্ষমতা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। এটি অস্বস্তিতে ফেলেছিল রাষ্ট্রকে। ফলে, দৃশ্যপট থেকে তার মুছে যাওয়াটা জরুরি ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জরুরি কাজটি বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়েছে। আর এখন মিন্নির সপ্রশ্ন ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ সেই অস্বস্তির গায়ে শেষ প্রলেপটি দিয়ে দিয়েছে। কারণ, মানুষের দৃষ্টি এখন আর ‘বন্ড’ ও তাদের ‘শক্তির জোগানদাতাদের’ দিকে নয়, ঘটনার রহস্যের দিকে। মিন্নির দিকে।
শেষ পর্যন্ত মিন্নিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর এ ঘটনা আরও একবার সমাজের পুরুষ মানসটিকে দেখিয়ে দিয়েছে। ‘সংবেদনশীলতার’ মুখোশ পরে নেওয়া পুরুষদের প্রকৃত চরিত্রটি তিনি এক টানে উন্মোচন করে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, পুরুষাধিপত্যের অপরাধ জগতে কোনো নারীর নাম ওঠা মানেই হচ্ছে, সব নারীর একযোগে কোণঠাসা হওয়া। নারী তখন হয়ে ওঠে, সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধী। এমন একটি ঘটনা দিয়েই সমগ্র নারী সমাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যায়, যা পুরুষের ক্ষেত্রে কখনো যায় না। প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘সব পুরুষ এমন নয়’, যার মধ্যেই অবশ্য আছে নির্যাতন তথা অপরাধের জগতে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রমাণ। এই আধিপত্য একই সঙ্গে নির্বিরোধী, কিন্তু প্রায় সম-মনোভঙ্গি নিয়ে চলা পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তির জন্ম দেয়, যা মাঝে মাঝে কোনো না কোনো মিন্নি এসে প্রশমিত করার সুযোগ করে দেয়। এই প্রশমন আবার পুরুষের নির্যাতনস্পৃহাকে এক ধরনের অঘোষিত ছাড়পত্র দেয়। যত দিন এ ছাড়পত্র দেওয়া হবে, তত দিন কোনো আইন বা কোনো কিছুই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাকে রোধ করতে পারবে না।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]