নির্জন প্রকোষ্ঠে ১৭ শ ফাঁসির আসামির চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় থাকার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্পর্ক নাকচ করা যাবে না। ৩০ লাখ মামলাজটের সমস্যা থেকে এসব মামলার দ্রুত বিচারকে আলাদা করেই দেখতে হবে। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই যে এসব মামলার অপরাধের ধরন অত্যন্ত গর্হিত এবং ফাঁসির মতো দণ্ড কার্যত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ। তাই এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা সমাজে একটি উদ্বেগজনক বার্তা বহন করে।
কিন্তু কিছু পরিস্থিতি রয়েছে, যা দূরদর্শিতা দিয়ে প্রতিহত করতে হয়। ফাঁসির মামলার দ্রুত শুনানির ক্ষেত্রে আজ যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে সরকারের দায় কম। কারণ, এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির। দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার জট বাড়তে না দিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হলে, শুধু আপিল বিভাগেই ৬ থেকে ১৫ বছর ধরে বিচারাধীন ফাঁসির মামলার সংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই হতো না।
২০১৫ সালের মে মাস থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ৪৮ জনের আপিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, হাইকোর্ট বছরে ১২টির বেশি মামলা সুরাহা করতে পারেননি। এই পরিসংখ্যান ঠিক হলে এবং বছরে যদি দ্বিগুণ সংখ্যক অর্থাৎ ২৪টি আপিল নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলেও, বর্তমান ব্যবস্থায় জট কাটাতেই ৭০ বছরের বেশি সময় লাগবে। এর শুনানি শেষ করতে বেঞ্চ বা শুনানি শুরুর জন্য পেপারবুক মুদ্রণেও হাইকোর্ট কর্মকর্তাদের জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই।
বিদ্যমান অচলাবস্থার অবসানে তাই প্রধান বিচারপতির বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এটাও ঠিক, বর্তমানে হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চ শুধু এমন মামলাই শুনছেন। এর মধ্যে যে তথ্যটি সব থেকে উদ্বেগজনক সেটা হলো, ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলতে থাকা তিনটি বেঞ্চ ২০১৪ সালের পরের মামলার শুনানি করতে পারেন না। ক্রমিক অনুসরণ দরকারি। কিন্তু এ নিয়মতান্ত্রিকতা অতিরিক্ত দীর্ঘসূত্রতা ডেকে আনছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে যে ভয়ানক অভিঘাত ফেলে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গই নির্বিকার থাকতে পারে না।
ফেনীর নুসরাত কিংবা বরগুনার রিফাতের ঘাতকদের বিচারে সমগ্র জাতি যখন দ্রুত বিচার আশা করছে, তখন রূঢ় বাস্তবতা হলো, পাঁচ বছরের
বেশি সময় আগে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের কনফার্মেশন শুনানি এক অর্থে স্থগিত রয়েছে। যদিও আমরা জানি, ক্রমিক ডিঙিয়ে হাইকোর্ট রাজীব, রাজন,
খালাফ, সাত খুন ও পিলখানা হত্যা মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করায় মানুষ আশ্বস্ত হয়েছে।
এখন কী করা উচিত, তা নিয়ে আমরা আইন কমিশন ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টির সুরাহা খুবই দুরূহ। যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা কখনো দীর্ঘ কারাবাসের পরে জামিন পেতে পারেন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা জামিন কল্পনা করতে পারেন না। আবার ১৫ বছর নির্জন প্রকোষ্ঠে থাকার পরও যাঁরা খালাস পাবেন, রাষ্ট্র তাঁদের ক্ষতিপূরণও দেবে না। অথচ বিলম্বিত শুনানির জন্য ফাঁসির আসামিদের দায়ী করা যাবে না। তাই জেল কোড শুধরে নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখার বিধান শিথিল করা যায় কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
পাঁচটি বেঞ্চ একসঙ্গে কাজ করলে ১০ জন অভিজ্ঞ বিচারপতি ও অন্তত ১০ জন আইনজীবীর দরকার হবে। এটা কঠিন হলেও এর বিকল্প নেই। এটা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট, সংসদীয় কমিটি ও আইন মন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা করে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পারে।