জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তন দেশের ভূখণ্ডগত এবং সাধারণ মানুষের জীবনে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনার আশঙ্কা সত্ত্বেও এ-সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক মনোভাবে কোনো পরিবর্তন ঘটছে না।
১৭টি জলবায়ু ও ১৪টি এডিপি প্রকল্পের ৩৯০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে টিআইবির পরিচালিত গবেষণার শিরোনাম ‘জলবায়ু ও উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সামঞ্জস্য নিরূপণ: কোনটি দক্ষ, কার্যকর ও স্বচ্ছ?’ উত্তর এসেছে, জলবায়ু ট্রাস্ট প্রকল্পের অধীনে নেওয়া প্রকল্পের চেয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে নেওয়া প্রকল্পগুলো বেশি সুফল দিচ্ছে। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এডিপির আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো কি উত্তম? অধিকতর জনবান্ধব? সম্ভাব্য ভুক্তভোগীরা যাতে সর্বোচ্চ সুবিধা পায়, সেটা ভেবেচিন্তেই কি এডিপির আওতায় প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে? এর উত্তর হ্যাঁ হলে আমরা আশ্বস্ত হতাম। কিন্তু সেটা হয়নি। সেই অর্থে টিআইবির প্রতিবেদন জেনে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ নেই যে এডিপির প্রকল্প মানেই গণমুখী এবং সুচিন্তিত। বরং টিআইবি গবেষণা এটাই বলেছে যে সব দিক বিবেচনায়, বিশেষ করে চাহিদা মূল্যায়ন না করে যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হচ্ছে, তা থেকে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত। অথচ এটা সবারই জানা যে বাংলাদেশ ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে যে পরিমাণ জলবায়ু তহবিল পাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। বাংলাদেশে অভিযোজন বাবদ বার্ষিক ২০০ কোটি ২০ লাখ ডলার চাহিদার বিপরীতে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ১১৩ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ মিলেছে এবং এর অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান কর্তৃত্বও বিদেশি সংস্থার হাতে। এটাও লক্ষণীয় যে ট্রাস্ট প্রকল্পে অনধিক ৩ কোটি টাকা এবং এডিপির অধীনে শত কি হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া যায়। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে কোনো প্রকল্পই উপযুক্ত চাহিদা মূল্যায়নের আলোকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
প্রায় এক দশক আগে থেকে ভবিষ্যতের জলবায়ু প্রকল্প নেওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ঝুঁকি যাচাই ও মূল্যায়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সে মূল্যায়নের প্রাথমিক রিপোর্ট করলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। সুতরাং একটি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনার আওতায় জলবায়ু প্রকল্পগুলো যথাগুরুত্ব ও যত্নে বাস্তবায়ন হলে যে সর্বোচ্চ সুফল আশা করা সম্ভব ও স্বাভাবিক ছিল, সেটা চলমান অ্যাডহক মনোভাব দ্বারা চালিত প্রকল্পগুলো থেকে আশা করা যাবে না। উপরন্তু টিআইবি কয়েক বছর আগেই আমাদের জানিয়েছিল যে জলবায়ু প্রকল্পেও দুর্নীতির থাবা পড়েছে।
কোন এলাকার মানুষের কিসের চাহিদা কতটা এবং কোথায় কী ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলে সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের চাহিদা মেটানো যাবে ও তাদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে, তা যথাযথভাবে ঝুঁকি মূল্যায়ন দ্বারাই নিরূপণ করা সম্ভব। যেমন কোথাও বিদ্যালয় নির্মাণের সময়েই তাকে প্রয়োজনের সময় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা, বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি মনে রেখে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, লবণাক্ত-সহিষ্ণু ফসল ফলাতে উপকূলীয় কৃষকদের উৎসাহিত করার মতো আগাম কৌশল নেওয়া প্রয়োজন।
টিআইবির নতুন গবেষণাপত্র তিনটি বিষয়ের প্রতি দ্রুত নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য স্থায়ী ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটানো। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডে মন্ত্রীদের প্রাধান্যের অবসান ঘটানো। কারণ, টিআইবির সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে মন্ত্রীর উপস্থিতির ফলে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে। তার প্রমাণ ট্রাস্টের অধীনে অধিকাংশ প্রকল্প মন্ত্রীদের এলাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। তৃতীয়ত, চলমান এডিপি প্রকল্পের নিরীক্ষা, মূল্যায়ন ও তদারকি কৌশল জলবায়ু প্রকল্পেও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।