পানির অপর নাম জীবন। আর সেই ‘জীবন’ নিয়ে অব্যাহতভাবে ছিনিমিনি খেলছে ঢাকা ওয়াসা। হাইকোর্টে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন বলেছে, দৈবচয়নের ভিত্তিতে ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন জোন থেকে সংগ্রহ করা ৩৪টি নমুনার মধ্যে ৮টিতে ব্যাকটেরিয়াজনিত দূষণ পাওয়া গেছে। এই দূষণরোধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন আনার সদিচ্ছা ও সামর্থ্য রাখে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। খাওয়ার পানি নিয়ে রাজধানীবাসীর সংকটে থাকার বিষয়টি খোলামনে স্বীকার করা কিংবা সংকট নিরসনে তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন—এমন কোনো ধারণা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেননি। বরং তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি আদৌ সমস্যার অস্তিত্বকেই স্বীকার করতে চান না।
বিভিন্ন পেশাজীবীকে নিয়ে গঠিত ঢাকা ওয়াসার ১২ সদস্যের বোর্ডেরও জবাবদিহি দরকার। পানির মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠার পর এই বোর্ড রাজধানীর সামনে কোনো ব্যাখ্যা হাজির করেনি। অথচ ব্যবস্থাপনার তদারকি ও জবাবদিহির দায়িত্ব ১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন তাদের হাতেই ন্যস্ত রেখেছে। এই বোর্ডে অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তাঁদেরই সুপারিশে তিন বছর মেয়াদে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। আমরা সব সময় সরকারের কাঁধেই সব দায়িত্ব ও পদক্ষেপ আশা করি। সংসদ আইন করে বোর্ড তৈরি করেছিল এই আশায় যে ওয়াসা সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হিসেবে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে।
বোর্ডের উচিত এটা ব্যাখ্যা করা যে যা হাইকোর্টের রিটে বেরোল, কেন তারা তা নিশ্চিত করতে পারল না। এর আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ওয়াসা কার্যক্রমে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিল। কমিটি ডাকলেও তাতে এমডি সাড়া দেননি। তাই দায়িত্ব পালন না করে শুধু ওয়াসার বোর্ডের সদস্যপদ অলংকৃত করে রাখা সামাজিক অন্যায়। এমনকি অনৈতিক বটে। বোর্ডের কাজে স্বচ্ছতা জরুরি। ২ জুলাই পানি শোধন-সংক্রান্ত ওয়াটার কোয়ালিটি মনিটরিং কমিটির সভার খবর ওয়াসা ওয়েবসাইটে আছে। কিন্তু অগ্রগতির তথ্য গোপনীয় রয়ে গেছে।
ওয়াসার ওয়েবসাইটের দাবি, ওয়াসা নাকি উন্নয়নশীল দেশের ‘রোল মডেল’। এর এমডি তাই ‘শতভাগ সুপেয়’ পানির তাত্ত্বিক হবেন, তাতে আর বিস্ময় কী। সম্প্রতি টিআইবি যখন সুপেয় নয় বলে ৯১ শতাংশ মানুষের পানি ফোটানোর তথ্য প্রকাশ করল, তখন তিনি টিআইবিকে নাকচ করে চেনা রাজনৈতিক আচরণটাই দেখালেন। অথচ আমরা পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে টিআইবি সমীক্ষাটি তাঁর এবং তাঁর দপ্তরেরই দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো, যা টিআইবি পারল, সেটা বোর্ডেরই কাজ ছিল। প্রতি ৬০ দিনে অন্তত দুবার বৈঠক করা এবং ওয়াসার নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুমোদনের দায় বোর্ডের। তবে সরকারকেই কৈফিয়ত দিতে হবে, কারণ বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য তারই মনোনীত।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পরিবর্তন না এনে ওয়াসার পানি ‘অবিলম্বে’ ব্যাকটেরিয়ামুক্ত বা সুপেয় করা সম্ভব কি না, তা এক বড় প্রশ্ন।
৯ বছর আগে আরেকটি রিটে বিএসটিআই ২২টি স্থানের নমুনার মধ্যে ১৫টিতেই ব্যাকটেরিয়া ও দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ পেয়েছিল। ৯ বছর পরে পানিতে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া এটা নিশ্চিত করল, মানুষ যা পান করছে, তা সুপেয় নয়। তিন বছর পর এমডি বদলানোর ক্ষমতা ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের রয়েছে। কিন্তু বর্তমান এমডি কীভাবে ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টিকে আছেন, সেই প্রশ্ন জ্বলন্ত।