বাংলাদেশ ও চীনের নেতাদের শীর্ষ বৈঠকে যত শিগগির রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনে গুরুত্ব আরোপের বিষয়টি যথেষ্ট ইতিবাচক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, উভয় নেতা একমত যে, ‘এ সমস্যা আর অমীমাংসিত রাখা যাবে না। রোহিঙ্গারা অবশ্যই নিজ দেশে ফেরে যাবে।’ এটা বাসসের খবর, এখন আশা করব, চীনা সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে বিশদ খবর দিয়ে বিশ্বকে আশ্বস্ত করবে।
এই ঘোষণায় অবশ্য চীনের শীর্ষ নেতার রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি তাঁদের চলমান নীতি ও সংকল্পেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ অতীতেও চীনের সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু অতীতের থেকে এবারের পরিস্থিতি নানা মাত্রায় জটিলতাপূর্ণ। এবার গণহত্যা সংঘটনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাতারাতি বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সে কারণে আমরা বরাবরই এটা জানতে উন্মুখ যে, রাখাইনে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়ে চীনা অবস্থান আসলে কী।
এটা অনুমেয় যে চীনসহ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অভিন্ন বন্ধুরা প্রত্যাবাসনবিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সাফল্য দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরের বাস্তবতা এটাই নির্দেশ করছে যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কোনোভাবেই আগ্রহী নয়। বরং প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার জন্য উল্টো বাংলাদেশকেই দুষেছে তারা।
বাংলাদেশের সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও গণহত্যার কুশীলবদের আইসিসিতে বিচার। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বাংলাদেশ চীনসহ সব মিত্রর তরফে দৃঢ় সমর্থন আশা করে। এ ক্ষেত্রে চীন ছাড়াও ভারত, রাশিয়া ও জাপানের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে আসছে। নীরব কূটনীতি যেহেতু কাজে দিচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে সরব কূটনীতিতে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের কাছে এটা যে পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়, নিরুপায় বাধ্যবাধকতা, এটা চীনের মতো স্বীকৃত কৌশলগত মিত্রদের বুঝতে হবে। চীন নিশ্চয় বিবেচনায় নেবে যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ যথেষ্ট সময় দিয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট সির ঐতিহাসিক সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়। অন্যদিকে গত এপ্রিলে মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে সি বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন যখন যেমনই হোক, চীন-মিয়ানমার সামরিক সম্পর্ক ‘ব্যাপকভিত্তিক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বের’ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুই নেতা অবশ্য ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশও এর বড় সমর্থক। সির বিশেষ পছন্দের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং রাখাইনে চীনা অর্থায়নে নির্মিত গ্যাস পাইপলাইন ইত্যাদির সঙ্গেও রাখাইনের স্থিতিশীলতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর চলমান শান্তি প্রক্রিয়াকে বেগবান করতে চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আছে। বৌদ্ধ সংগঠন এএ রাখাইনের স্বায়ত্তশাসন ও সেখানে তাদের একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠায় জোর সশস্ত্র লড়াই ও সংলাপ দুটোই চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তারা শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে না। ৬ জুলাই মিয়ানমার বলেছে, অস্ত্রবিরতির জন্য তারা এএর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। অপরদিকে শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গারা শুধুই নাগরিকত্ব পেলে সন্তুষ্ট।
এটা সুখকর যে ৪ জুলাই নেপিডোতে অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারে নবনিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। আমরা আশা করব, চীন তার প্রভাব ও শুভেচ্ছার শক্তি দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে সব রকম উদ্যোগ নেবে। এই সমস্যা জিইয়ে রাখা হলে সেটা ভবিষ্যতে চীনের জন্য শিরঃপীড়ারও কারণ হতে পারে।