কলম্বোর সাংবিধানিক আদালত ও ভারতের উত্তরাখন্ড হাইকোর্টের পরে বাংলাদেশের হাইকোর্ট সম্ভবত বিশ্বের তৃতীয় উচ্চ আদালত, যাঁরা নদীকে জীবন্ত সত্তা ও লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করলেন। মাইলফলক এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এতে প্রথমবারের মতো নদীদূষণ ও দখলকারীকে ব্যাংকঋণ গ্রহণ ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ নদী বাঁচাতে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব কটি নির্দেশনা নদী রক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানের কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতাকে পর্যালোচনা করে উপযুক্ত করণীয় নির্দেশ করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। উপরন্তু হাইকোর্ট পরিষ্কার বলেছেন, ওই নির্দেশনাবলির প্রতিটি দেশের প্রচলিত আইনের অংশ হিসেবে গণ্য হবে। এভাবে উচ্চ আদালত তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন, এখন নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভাকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যদিও উঠতে-বসতে আমরা সারাক্ষণ অনুভব করি যে নদীই বাংলাদেশ। নদী বাঁচলে বাংলাদেশের মানুষ ও জীববৈচিত্র্য বাঁচবে। কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের বিচারপতিরা কলম্বো ও উত্তরাখন্ডকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অনুসরণ করতে পারলেও আমাদের রাজনীতিকেরা নিউজিল্যান্ডের আইনসভাকে অনুসরণ করতে পারেননি। নদী বাঁচাতে বিশ্বের প্রথম আইনসভা হিসেবে তারা নদীকে মানবসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে আইন করেছে। আমরা আশা করব, তুরাগ নদকে রক্ষার সূত্রে আমরা হাইকোর্টের যে পূর্ণাঙ্গ রায়টি সম্প্রতি পেলাম, সেটি অনুসরণে আইনসভা যেন যথাযথ সংবেদনশীলতা দেখাতে সক্ষম হয়। সরকার যথাবিহিত পদক্ষেপ নিতে শিথিল কিংবা দীর্ঘসূত্রতার কোনো মনোভাব দেখালে আইনসভা যেন নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং রায়টি বাস্তবায়নে সজাগ থাকে।
২০০৯ সালে দেওয়া হাইকোর্টের আরেকটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৩ সালে একটি নতুন আইনের আওতায় আমরা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন পেয়েছিলাম। গত ছয় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, নদী রক্ষা কমিশনকে একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলেও বাস্তবে তাকে শুধুই সুপারিশদানের ক্ষমতা দিয়েছে। নদী কমিশন সারা দেশের নদীর অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা ডেপুটি কমিশনারদের প্রশংসনীয় সহযোগিতায় প্রস্তুতের কাজ প্রায় চূড়ান্ত করেছে। দেখা যাচ্ছে, আর্থিক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকের সামনে যতটা চ্যালেঞ্জ, তার থেকে দখলবাজদের উচ্ছেদ করার চ্যালেঞ্জ কোনো অংশে কম নয়। নদী কমিশন অবিলম্বে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ১০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দাবি করে আসছে। ডিসিদের চাহিদার ভিত্তিতেই এই খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলো, গত অর্থবছরে এই খাতে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। নতুন অর্থবছরে এর পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে বাড়তে পারে, তার লক্ষণ অনুপস্থিত।
হাইকোর্ট নদী দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা, দূষণকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় এবং নদী বা জলাশয়-সংশ্লিষ্ট যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হলে কমিশনের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার মতো বেশ কিছু নতুন বিধান দিয়েছে। একে কার্যকর করতে হলে বিদ্যমান আইন এবং নদী কমিশনটির সাংগঠনিক বিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনটিতে দ্রুত সংশোধনী আনা অপরিহার্য। স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নদী কমিশনকে ঢেলে না সাজালে হাইকোর্টের নির্দেশনাবলি কার্যকর প্রায় অসম্ভব থাকবে।
হাইকোর্ট নদী কমিশনকে নদ-নদীর ‘আইনগত অভিভাবক’ এবং দেশের অন্য সব বিভাগ ও সংস্থাকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। তাই এই বিশাল দায়িত্ব পালনে কমিশনকে দুদক ও মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি আধা সাংবিধানিক সংস্থায় রূপ দেওয়া একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।