হামলা ছিল হঠাৎ বজ্রপাতের মতো: আছাদুজ্জামান মিয়া
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে যে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত জঙ্গি হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়, সেটি ছিল আমাদের কাছে হঠাৎ একটি বজ্রপাতের মতো। আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, সহাবস্থানের ঐতিহ্য; সেখানে এমন হামলা হতে পারে, এটি আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল।
ভয়ংকর সেই হামলায় দেশি-বিদেশি ২২ জন জীবন দিয়েছেন। এর মধ্যে আমার দুজন প্রিয় সহকর্মীও আছেন। তাঁরা হলেন বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান ও মেধাবী তরুণ অফিসার এসি রবিউল করিম। সেদিন আমি নিজে ২০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। সেখানে থাকা আমাদের ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে ঘটনা জানার চেষ্টা করি।
জঙ্গিদের হামলার মিনিট দশেকের মধ্যেই একজন ব্যক্তি, যিনি হোলি আর্টিজানে আটকা পড়েছিলেন, তিনি টেলিফোন করলেন আমাদের ডিসি সাহেবকে। জানালেন, একজন ইতালিয়ান, একজন আর্জেন্টাইনসহ তাঁরা বেশ কিছু লোক হোলি আর্টিজানের একটি অংশে আটকা পড়েছেন। সন্ত্রাসীরা সে সময় ভেতরে ছিল, তাঁরা ওখান থেকে বের হতে পারছিলেন না। তিনি তাঁদের উদ্ধার করার জন্য আমাদের সহযোগিতা কামনা করেন।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হোলি আর্টিজানের গেটের ভেতরে ঢুকব কাউন্টার ফায়ার করতে করতে, যাতে আটকা পড়া লোকগুলোকে আমরা উদ্ধার করতে পারি। এরপর আমরা ফায়ার করতে করতে ঢুকে যাই। একজন আর্জেন্টাইন, একজন ইতালিয়ান, সাতজন বাংলাদেশিসহ নয়জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তাদের উদ্ধার করে আমরা যখন হোলি আর্টিজানের গেট দিয়ে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিলাম, গেট থেকে ২০ গজ পার হওয়ার আগেই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয়। গ্রেনেডটি একেবারে পেছনে বিস্ফোরিত হয়। ফলে আমরা যারা সামনে ছিলাম, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাই। আমাদের চোখের সামনে দুজন সহকর্মী মারা যান।
এরপর আমাদের আরও অফিসার গেল, সোয়াত, বোম ডিসপোজাল ইউনিট, র্যাব গেল। আমরা পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলি। সন্ত্রাসীরা যাতে লেক দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য লেকে বিজিবির একটি দল এবং লেকের ওপারে ভাটারা থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশের আরেকটি দলকে মোতায়েন করা হয়।
একপর্যায়ে আমি মুঠোফোনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে আমার অবস্থান কোথায়। তখন আমি বললাম, হোলি আর্টিজানের ঠিক পাশের ভবনের নিচতলায় আমরা কিছু লোক অবস্থান নিয়েছি। আর বাকিদের চারপাশে ভাগ দিয়ে আমরা কাউন্টার ফায়ারের মাধ্যমে তাদের মোকাবিলা করছি।সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তখন আমাদের সর্বোচ্চ দূরত্ব ২০-২৫ গজ। এর মধ্যে তখন সালাহউদ্দিন খান ও রবিউল করিমের মৃত্যুর খবর প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করি। তিনি বললেন, তোমরা আর এক পাও অগ্রসর হইয়ো না। নিজেদের নিরাপত্তা ঠিক রেখে চতুর্দিকে ঘেরাও কর সন্ত্রাসীরা যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে। আমি সেনা কমান্ডোদের পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
সেনা কমান্ডোরা ভোররাতের দিকে এলো। আমরা চারপাশ পরিদর্শন করি। ইতিমধ্যে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, নেভি কমান্ডো ও স্নাইপারেরা অবস্থান নিয়ে নেয়। সেনা কমান্ডোরা একটি অপারেশনাল ম্যাপ তৈরি করে আমাদের সহায়তায়। এরপর অপারেশনাল প্ল্যান নিয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করি, তখন রাত চারটা। বিস্তারিত আলোচনা শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যৌথ অভিযানের সিদ্ধান্ত দেন। সেনা কমান্ডোরা মূল অভিযান করবে। এর সহযোগী হিসেবে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি আমরা সঙ্গে থাকব। এ সিদ্ধান্তের আলোকে ভোরবেলায় অভিযান শুরু হয়। অভিযানে পাঁচজন সন্ত্রাসীর সবাই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। তাদের সঙ্গে হোলি আর্টিজানের একজন কর্মীও পালাচ্ছিলেন। প্রাথমিকভাবে ও যুক্তিসংগতভাবে মনে হয়েছিল তিনিও জঙ্গি। অভিযানে তিনি নিহত হন। সেখান থেকে আমরা মোট ২১ জনের মতো জিম্মিকে উদ্ধার করি—সেনাবাহিনী এবং আমরা মিলে আগে-পরে।
এ ঘটনার পর গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—আমরা সবাই যার যার মতো করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৬৩টি ছোট–বড় অভিযান পরিচালনা করেছি। এর অধিকাংশ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) অধীনে পরিচালিত হয়। এলাকায় এসব অভিযানে অনেক চিহ্নিত উগ্রবাদী নিহত হয়। অনেককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।
যদিও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু উগ্রবাদী সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে মাঝেমধ্যে। আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা মনে করি, গোয়েন্দা সংস্থা, সিটিটিসি, পুলিশ সদর দপ্তর, র্যাব—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্কটাকে ভেঙে দিতে পেরেছি। নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। সমূলে উৎপাটন করতে এখনো পারিনি। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কিছু কিছু কর্মকাণ্ড আমাদের গোচরীভূত হচ্ছে। তবে বড় ধরনের হামলা করার সক্ষমতা জঙ্গিদের আছে; সেটা প্রতীয়মান হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কিছু করার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। একই সঙ্গে এই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, সচেতন করার কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি।
মো. আছাদুজ্জামান মিয়া: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার