বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ড আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক ব্যাধির এক ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেছে। সমাজে এমন ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে অপরাধীরা একজন মানুষকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করলেন, আর নিহত ব্যক্তির স্ত্রী ছাড়া কেউ তাঁদের রুখতে এগিয়ে এলেন না। যাঁরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই মাদক ব্যবসা, ছিনতাইসহ নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত থাকলেও প্রশাসন তাঁদের নিবৃত্ত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
হত্যার মূল হোতা সাব্বির আহম্মেদ নয়ন, যিনি নিজেকে নয়ন বন্ড নামে জাহির করতেন, তাঁর বিরুদ্ধে মাদকসহ ১০টি মামলা আছে। তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধেও কমবেশি মামলা আছে। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে বরগুনায় ০০৭ নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী ছিল নির্বিকার। নয়ন বন্ড ২০১৭ সালে মাদকসহ হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা ঘোষণা করলেও নয়ন বন্ডের মতো আরও অনেকে প্রশাসন ও ক্ষমতার আশ্রয়ে বহাল তবিয়তে আছে। সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে ও আওয়ামী লীগ নেতা সুনামের সঙ্গে নয়নের সখ্য ছিল বলে অভিযোগ স্থানীয় ছাত্রলীগের। অন্যদিকে নয়ন বন্ডের দুই সহযোগী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ দেলোয়ার হোসেনের নিকটাত্মীয়। ফলে বরগুনায় এই অপরাধী চক্র কাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
শুধু বরগুনা নয়, প্রায় সবখানেই দেখা যায়, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে অপরাধী চক্রের একটি অলিখিত আঁতাত থাকে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও অপরাধী চক্রকে ব্যবহার করা হয়। নারায়ণগঞ্জে মাদক চক্রের হোতা নূর হোসেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করেছিলেন। ফেনীতে নুসরাত নামের এক মাদ্রাসাছাত্রী অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্বারা অপমানিত হয়েছেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজ উদদৌলাকে রক্ষা করতে গিয়ে এখন কারাগারে। বরগুনায় নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মাদক চক্র ও সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের কারও সখ্য ছিল কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে নয়ন তাঁকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। কিন্তু কেন পুলিশ প্রশাসন নিশ্চুপ ছিল?
রিফাত হত্যার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আসামিদের গ্রেপ্তার করতে নির্দেশে দিয়েছেন। আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর হয়ে উঠেছে, যদিও প্রধান অভিযুক্তরা কেউ গ্রেপ্তার হননি। প্রশাসনের এসব তৎপরতা কতটা লোকদেখানো আর কতটা আন্তরিক, সে প্রশ্নও না উঠে পারে না। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো অঘটন ঘটলে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কিছুদিন পর আগের মতোই সবকিছু চলতে থাকে। সমাজে মাদকের ব্যবসা ও ক্ষমতার আশ্রয়ে যে বিষবৃক্ষ তৈরি হচ্ছে, তাকে নির্মূল করতে না পারলে এই সমাজ ও রাষ্ট্রে কেউ নিরাপদ থাকবে না। নুসরাতের পর রিফাতকে জীবন দিতে হয়েছে। এরপর হয়তো আরও কেউ ঘাতকদের জিঘাংসার শিকার হবেন।
কোনো সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে এই অবস্থা চলতে পারে না। মাদকের ব্যবসা ও ক্ষমতার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা দুর্বৃত্তদের এখনই নিবৃত্ত করুন। রিফাত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। মুখোশ উন্মোচিত হোক তাঁর নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষকদের।