ছাত্রছাত্রী ও কৃষকের ডুমুরিয়া মডেল
বাংলাদেশের লোকপ্রিয় এক স্লোগান হলো ‘ছাত্র-জনতার ঐক্য’। ইতিহাসে পুনঃপুন এই স্লোগানের নজির আছে। এ রকম ঐক্যের দৃষ্টান্তও আছে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের নিরস্ত্র ও সশস্ত্র পর্যায়ের প্রধান শক্তির জায়গা ছিল জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে ছাত্র-জনতার মিলিত সংগ্রাম। নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসনামলেও সে রকম সম্মিলন দেখেছি আমরা। আরও আগে, মুক্তিযুদ্ধের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে গ্রামে যেতে দেখা গেছে কৃষিসংস্কার উদ্যোগে অংশ নিতে। কোথাও কোথাও সাক্ষরতার আন্দোলন গড়তে। অনেক তরুণ-তরুণী গ্রামে গিয়েছিলেন নতুন ধারার সাংস্কৃতিক জাগরণের অংশ হয়েও। সেসব থেকেই গণথিয়েটারসহ বহু অর্জন দেখেছি আমরা। এসব থেকে কী পাওয়া গেল, কতটা টেকসই হলো সেসব প্রাপ্তি, তা নিয়ে অনেক মত আছে। ভিন্নমতও আছে। ‘পরিবর্তন’-এর স্বপ্নই এসব ঐক্যচেষ্টার চালিকা শক্তি ছিল। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির চোখ দিয়ে দেখলে এই ঐক্যের সমাজতাত্ত্বিক শক্তির জায়গাটা ধরা যায় না।
১৯৯০-এর পর থেকে এরূপ ঐক্যকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করার মৌসুম শুরু। প্রবলভাবে ‘ক্যারিয়ার’ প্রশ্নটা হাজির করা হয় শিক্ষার্থীদের সামনে। মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, মাটি-পানি-আবহাওয়ার সঙ্গে মেলামেশা, বোঝাপড়াকে ক্যারিয়ারবিরোধী সাংঘর্ষিক ব্যাপার হিসেবে সূক্ষ্ম প্রচার চলে। নিতান্তই শহুরে ধাঁচের প্যান্ট-শার্ট পরা সংকীর্ণ এক আর্থিক প্রবৃদ্ধির ডাকে সাড়া দেওয়াই তারুণ্যের ধর্ম হিসেবে হাজির হয় নাটক-গান-মিডিয়া-বিজ্ঞাপনে। এই প্রচার-আন্দোলনও সফল ছিল। তারই ফল হিসেবে অর্ধমৃত গ্রামসমাজের বিপরীতে চাকচিক্যময় অপ্রতিরোধ্য এক ঢাকা পাওয়া গেল।
ছাত্র-জনতার ওই ফাটলেরই ফল শহুরে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে গ্রামীণ মাদকাসক্তি। দেশের রাজনীতি যে ব্যবসায়ীদের জিম্মায় গেল, সংস্কৃতি যে করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেসবও একই সংক্রমণের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রাপ্তি। ‘ছাত্র-জনতার-ঐক্য’-এর দুর্বলতায় এসব হতে পারল। কীভাবে সেটা হলো, সমাজবিদ্যার জন্য বিরাট পাঠ হয়ে আছে তা।
তারপরও যৌথতার ধারণা মরে গেছে, এমন নয়। দেশের নানান প্রান্তে তরুণ-তরুণীরা বহুভাবে ‘সমাজ’-এর সঙ্গে সম্পৃক্তির চেষ্টা জারি রেখেছেন। সে রকম একটি উদ্যোগের পটভূমি হিসেবেই ওপরের কথাগুলো বলা।
খালিশপুর থেকে ডুমুরিয়া: দূরগ্রামের ডাক
‘ডুমুরিয়া মডেল’-এর চরিত্র বেশি নয়। সবার নামও জানা হয়নি। কেবল রিদয়, রুহুল, সাম্য, মিহির, দোলনসহ কয়েকজনকে সামান্য চিনি। আরও ১০-১৫ জন আছেন তাঁরা। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়েন। কেউ কেউ ক্যাম্পাসজীবন শেষ করেছেন কিছুদিন হলো। তাঁরা কেউই ‘পড়ালেখা’য় ফাঁকি দেননি কিন্তু মূল সমাজের সঙ্গে মেলামেশার আকর্ষণও হারাননি। কেউ মাদকে আকর্ষিত নন। কারণ, সমাজের ভেতরে প্রতিদিন আসক্তি খুঁজে পান তাঁরা। রাজনৈতিক আদর্শবাদ তাঁদের চালকের আসনে থাকলেও দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের চেনা। তাঁরা ঘুরছেন, হাঁটছেন, বসছেন, গল্প করছেন, নতুনভাবে সমাজকে বুঝতে চাইছেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ খুঁজছেন। মূলত মানুষকে কাছে টানায় আসক্তি তাঁদের। এই তরুণ-তরুণীদেরই গত মে মাসে খালিশপুরের পাটকলশ্রমিকদের পাশে দেখেছিলাম আমরা। ছবিতে। ফেসবুকে।
গেল পবিত্র রমজানে সেখানে আন্দোলনের দিনগুলোতে শ্রমিকদের নিয়মিত ইফতার করাতেন, পানি খাওয়াতেন তাঁরা। কিন্তু শুধুই সমাজসেবা লক্ষ্য ছিল না। সাম্য-রুহুল-দোলনরা সেখানে গিয়েছিলেন মজুরির আন্দোলনকে দেশের পাট খাত পুনর্জাগরণের আন্দোলনে রূপান্তরের চিন্তা থেকে। চারপাশে স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন সিন্ডিকেটের রক্তচক্ষু ছিল। প্রবলভাবে ‘রাষ্ট্র’ও ছিল। আরও ছিল প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্যাঁচাল অসহযোগিতা। কিন্তু এই তরুণদের ধৈর্য ও দৃঢ়তা সেসব এড়িয়ে যাচ্ছে। মে ২০১৯ খালিশপুরের বৈকালিক অবরোধগুলোতে শ্রমজীবীদের সঙ্গে মেলামেশায় পরিবর্তবাদী ভবিষ্যতের স্বরূপটি দেখেছে এই তারুণ্য। তাঁরাই খালিশপুরের পাশাপাশি ডুমুরিয়ার পথে এখন। খালিশপুরে শ্রমিকদের ১০ সপ্তাহের বকেয়া মজুরি হাতে পাওয়ার খুশি দেখে এক প্রস্থ শিখেছেন তাঁরা। মজুরি মানে ভাত। মজুরি মানে সন্তানের হাসিমুখ। শুধু মজুরি মানে নতুন করে পুরোনো বঞ্চনাও বটে। কিন্তু বাকি সংগ্রামের রাস্তাও দীর্ঘ কেবল। এসবের মধ্যেই দূরগ্রামের ডাক এল। ধান কাটতে নয়, ধানের অর্থনীতি বুঝতে, কৃষিসমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে। মানুষের মিলিত সম্ভাবনার কৌশল শিখতে।
ডুমুরিয়া: কৃষি অর্থনীতি যখন বোবা আক্রমণে পড়েছে
খালিশপুর যেখানে আধা শহুরে শ্রমিকপল্লি ডুমুরিয়া, সেখানে বেশ গ্রাম। ‘ঘের’ অর্থনীতির মধ্যেই শেষ প্রজন্মের আবাদিদের টিকে থাকার সংগ্রাম চলছে সেখানে।
খালিশপুরে শ্রমিকদের সঙ্গে তরুণদের সংহতি ও মেলামেশার দিনগুলোতেই দেশজুড়ে ধানচাষিদের সংকটটি সামনে আসে। বাম্পার ফলনের মুখে ধানের দাম না পাওয়ায় গ্রামের গর্ভ থেকে যে আর্তনাদ ওঠে, সেটা বুঝতেই আলমগীর-সাম্য-দোলন-উর্বীদের শহর খুলনা থেকে ডুমুরিয়ার দিকে যাওয়া।
এক দিন-দুই দিন-বহু দিন যেতে যেতে তরুণদের এই দলকে পছন্দ হয় আবাদিদের। তাঁরাই এখন তাঁদের চাইছেন। তাঁরাই চা খাওয়ান। ডেকে ঘরের উঠানে বসান। এই আবাদিরা খালিশপুরের শ্রমিকদের মতোই অনেকে ঋণগ্রস্ত। মণে মণে ধান ফলিয়েও অভাবে তাঁরা। অনেক ঘরেই অসুস্থ মানুষ। এ রকম অসুস্থতা খাবারের অভাবে ততটা নয়, যতটা মানসিক টেনশন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায়।
শহুরে এই ছাত্রদের কাছে পেয়ে গ্রামীণ আবাদিরা বিস্মিত ও খুশি। গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর মুরব্বি টাউটদের হাত থেকে তরুণ-তরুণীদের রক্ষায়ও এগিয়ে এসেছেন তাঁরাই। এই তরুণেরা যেন তাঁদের হারিয়ে ফেলা আত্মবিশ্বাসের ঝলক। বুড়োরা এ-ও বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে এভাবে শহুরে তরুণদের গ্রামে আসতে দেখেছেন।
ছাত্র-জনতার এই ঐক্য সেখানে ধানের ন্যায্যমূল্যের জন্য সংগ্রাম গড়ে তুলতে সচেষ্ট এখন। যে ধান ফলাতে মণপ্রতি সাত-আট শ টাকা খরচ, সেটাই বিক্রি করতে হচ্ছে কোথাও সাড়ে পাঁচ শ, কোথাও ছয় শ টাকায়। ডুমুরিয়ার রংপুর ইউনিয়নে পাঁচ শ টাকায়ও ধান বিক্রি হয়েছে। সোবনা ইউনিয়নে কৃষকেরা হিসাব করে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে তাঁদের মণপ্রতি ক্ষতি দুই শ টাকা। রাস্তার পাশে ভ্যান থামিয়ে চালক দেখাচ্ছিলেন ধান তুলে ঋণের কিস্তি দেওয়া যাবে না দেখে চাষিরা পাকা ধান খেতে রেখে পালিয়েছেন।
জনপদজুড়ে এ রকম বিপুল ক্ষতি একধরনের বোবা আক্রমণের মতো। এই আক্রমণে বসে পড়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে ভোট দেওয়া চাষিরাও। এভাবে বাংলাদেশ তার কৃষি অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, সেটা অবোধগম্য নয়। বিপরীতে ফুলেফেঁপে উঠছে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া অর্থনীতি ও চাতালমালিকানা। সরকার ১০৪০ টাকায় ধান কিনতে চাইছে। কিন্তু ধান বিক্রির অনেক কার্ডই স্থানীয় অচাষি প্রভাবশালীদের হাতে। কৃষকেরা এ-ও অভিযোগ করলেন, কার্ডপ্রতি ধান কেনার পরিমাণও নাকি কমে যাচ্ছে।
ডুমুরিয়ার ছাত্র-জনতা চাইছেন বাজেটের আগেই কিছু হোক
ডুমুরিয়ায় বড় রাস্তার পাশে অনেক ঘের। রাস্তা পেরিয়ে ভেতরমুখী হলেই বোঝা যায় এই জনপদ বেঁচে আছে কৃষির ওপর ভরসা করে। এ রকম একটি এলাকায় সরাসরি এই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, জমির ধান বিক্রি করতে না পেরে অনেক খুদে চাষি পরের জমিতে ‘জোন খেটে’ সংসার চালাচ্ছেন এখন। প্রায় সবাই বলছেন, আগামী বছর থেকে নিজের খোরাকি বাদে আর ধান লাগাবেন না। হতাশামিশ্রিত এই ভাবনা আসলে সর্বহারা কৃষকের আর্তনাদমাত্র।
কিন্তু এর বিকল্প কী? সেটাই খুঁজছেন ‘ডুমুরিয়া মডেল’-এর সংগঠকেরা। জুনের শেষ সপ্তাহে সেখানে কৃষকেরা সমবেত হতে চান। নিজেরাই মাইকিং করে পরস্পরকে জানাচ্ছেন সেটা। ইউনিয়ন পর্যায়ে এসে হাটে খোদ কৃষকের কাছ থেকে সরকার ধান কিনুক, এটাই চাইছেন এখানকার মানুষ। ক্রয়কেন্দ্র উপজেলা ছেড়ে অন্তত ইউনিয়নে আসুক। প্রতিটি ইউনিয়নে গুদাম তৈরির দাবিও উঠেছে। ঋণগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ মওকুফের আরজিও আছে। ঢাকার ঋণখেলাপিদের হাজার হাজার কোটি টাকা মওকুফের খবর ডুমুরিয়ায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে সবার জানা। তাঁরা অতটা নয়, কেবল আবাদ করে সর্বস্বান্তদের ঋণগুলোর সুরাহা চাইছেন এবং চাইছেন সংসদে বাজেট পাশের আগেই কিছু হোক।
আপাতদৃষ্টিতে ডুমুরিয়াবাসীর দাবি সামান্য হলেও তার ফয়সালা সহজ নয়। বাংলাদেশে শহরের সব শক্তি যখন সংগঠিত, গ্রামে ঠিক উল্টো চিত্র। কৃষকদের কোনো সংগঠন নেই। খালিশপুরের তরুণদলকে পেয়ে ডুমুরিয়ায় কৃষকসমাজ সংগঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
তরুণদের সঙ্গে চাষিদের উঠান বৈঠক, চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে এ রকম বোঝাপড়া এখন সেখানে প্রবল। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নটি কেবল চাষি সমাজের নিজস্ব বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন এবং শেষ বিচারে জাতীয় অর্থনীতি রক্ষার দায়। খুলনা থেকে যাওয়া মিতু-বাদল-সুমনা-মিহিরদের সঙ্গে ডুমুরিয়ার কৃষকদের বন্ধনটি গড়ে উঠতে চাইছে ঠিক এখানেই। বাস্তবতাটি বদলাতে চান তাঁরা নিচ থেকে, গ্রাম থেকে, খোদ কৃষক, খোদ শ্রমিকের সঙ্গে থেকে। ঢাকার তোপখানা রোড, প্রেসক্লাব, মিডিয়া, আলোকচিত্রীর ক্লিক ক্লিক ইত্যাদি থেকে এই তরুণ-তরুণীরা অনেক দূরে এখন। আপাতত তাঁরা আর কেন্দ্র ঢাকায় ফিরতে চাইছেন না। পথ খুঁজছেন পথে নেমেই। খালিশপুর, ডুমুরিয়া হয়ে নতুন কোথাও যাবেন তাঁরা।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক