দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যদি চালকদের ব্যবহারিক পরীক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তবে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তেমন লক্ষ্য অর্জনে নিজেদের সামর্থ্য বাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কোনো প্রয়াস আমাদের চোখে পড়েনি। এমন একটি বাস্তবতায় আকস্মিকভাবে ৭০০ গাড়ি আমদানির মতো একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেওয়া আমাদের অবাক করেছে।
বিশ্বের দেশে দেশে ইতিমধ্যেই একটি কার্যকর চালক পরীক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। উন্নত দেশগুলোতে অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর পরীক্ষা দিতে হয় এবং স্কুলের তরফে পরীক্ষার যানবাহন সরবরাহ করা হয়। আমাদের বর্তমান আইন বলছে, নিজস্ব যানবাহন সঙ্গে নিয়ে এসেই চালককে তাঁর পরীক্ষা দিতে হবে। অথচ সব চালকের নিজস্ব গাড়ি থাকার সুযোগ নেই। এই সুযোগে পরীক্ষাসংক্রান্ত গাড়ি ভাড়া নিয়ে বাণিজ্য এই মাত্রায় জেঁকে বসেছিল যে এই বাণিজ্য বন্ধ করতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অভিযান চালাতে হয়েছে। বিআরটিএ নিজে তা সামাল দিতে পারেনি।
সুতরাং সবার আগে যেটা দরকার সেটা হলো, প্রচলিত ব্যবস্থার দুর্বলতা, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। বিআরটিএর কার্যক্রমে দীর্ঘকাল ধরে যে অনিয়ম-দুনীতি বাসা বেঁধেছিল, সেটা শুধরে নিতে বিআরটিএকে আমরা উতলা হতে দেখি না। ঢাকাসহ মহানগরগুলোতে দৈনিক ৪৫০ এবং জেলাগুলোতে ১৫০ জনের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এবং বিআরটিএ অনুমোদিত ১২৮টি ড্রাইভিং স্কুলে হালকা যানবাহনের চালক প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা আছে, তাতে অনিয়ম দূর করে সেখানে পূর্ণ নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার শর্ত আগে পূরণ করা জরুরি। বিদ্যমান ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও গতিশীল করে গড়ে তুলে এই সংস্থাটির সামর্থ্য বহুগুণ বাড়ানো যেতে পারে।
কিন্তু সেসব দিকে মনোযোগ না দিয়ে শুধু চালকের পরীক্ষা নিতে একসঙ্গে ৭০০ গাড়ি ক্রয় করার কার্যত এক অবাস্তব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বিআরটিএর তরফে। এর আগে একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় ভারী যানবাহনের জন্য ছয় লাখ দক্ষ চালক তৈরির একটি ভালো কর্মসূচির কথা আমরা জেনেছি। ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে সচিবালয়ে এ-বিষয়ক একটি আলোচনায় প্রশিক্ষণের জন্য কিছু গাড়ির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ৭০০ গাড়ি আমদানির মতো কোনো আলোচনাই হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বিভিন্ন সরকারি পরিবহন পুল থেকে ব্যবহৃত গাড়ি সংগ্রহের ধারণা দিলে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা সেই ধারণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
সরকারি খাতের গাড়ি ক্রয়ে রক্ষণাবেক্ষণের ঝক্কি–ঝামেলা এড়াতে ইদানীং সরকারি কর্মকর্তাদের থোক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁরা নিজেদের গাড়ি নিজেরা কিনছেন। এর ফলে ক্রয়-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আর সরকারকে নিতে হচ্ছে না। এ রকম বাস্তবতায় ৭০০ গাড়ি কেনার ভাবনা বিআরটিএর নীতিনির্ধারকদের মাথায় আসে কী করে! এমন একটি পরিকল্পনার আগে এসব গাড়ির অপব্যবহার, অপচয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে যে হাতি পোষার মতো উচ্চ মূল্য গুনতে হবে, সেটা তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয় না। আর এ ধরনের কেনাকাটা যে দুর্নীতি ও ভাগ-বাঁটোয়ারার পরিস্থিতি তৈরি করে, তা–ও কারও অজানা নয়।
তবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান ১২ জুন প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ইঙ্গিত দেন, ওই ক্রয় সিদ্ধান্তটি প্রাথমিক, তাঁরা আউটসোর্সিংয়ের বিকল্পও ভাবছেন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আমরা একমত যে এই প্রকল্পটি এখনই বাতিলযোগ্য।