আওয়ামী লীগ সরকার এটি ভেবে স্বস্তি প্রকাশ করতে পারে যে গত দুই মেয়াদের শাসনে তাদের বড় ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার সাত ছাড়িয়ে আটে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারের স্ফীতিও আশাব্যঞ্জক। মুদ্রাস্ফীতিও মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। পদ্মা সেতুসহ চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে বলে ধারণা করা যায়।
কিন্তু এসব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। সরকার শেষ মুহূর্তে আরও দুই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কৃষক কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। তবে এই সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলে তাঁরা সহজেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতেন। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসা, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়া, ফি বছর বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণেও উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।
এসব ছাড়িয়ে সরকারের জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো ব্যাংকিং খাতের চরম নাজুক অবস্থা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই এবং তা এখন ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সরকার খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের নানা রকম সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সাফল্য আসেনি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘোষণা দিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু এরপরও ১৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। পুরো পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। আর এই খেলাপি ঋণের একটি অংশ যে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির মতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাত হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকারের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া কিছু অর্থ উদ্ধার করে সেটি বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছিল। দেশবাসীও তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গত ১০ বছরে পাচার হওয়া একটি টাকাও তারা ফেরত আনতে পারেনি বা আনার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এই ব্যর্থতার দায় সরকারকে নিতেই হবে।
এই প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন। তাঁকে যে বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে, সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি ও দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাজেট পেশকারী সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। তাঁর মতে, বাজেটের আকার আরও বেড়ে যাওয়া, আরও বেশি রাজস্ব আদায় এবং ব্যাংক খাতের উন্নয়নই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডিও বলেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে রয়েছে। এখন সরকার কীভাবে সেই চাপ মোকাবিলা করবে, সেটাই দেখার বিষয়। সংস্থাটি অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও কাঠামোগত সুশাসনসহ বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সিপিডির সুপারিশের মধ্যে মৌলিক ফারাক নেই।
প্রস্তাবিত বাজেটে যে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা খুব উচ্চাভিলাষী নয়। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রাক্কলিত রাজস্ব আহরণ ও প্রকল্প অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সঠিক ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে; অন্যথায় ‘মহাবিপদ’ দেখা দিতে পারে।