বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, কোনো কোনো বছর দেশের মোট চাহিদার অতিরিক্ত ধান-চাল উৎপাদিত হচ্ছে, এটা বেশ আনন্দের বিষয়। কিন্তু কৃষকের জন্য তা সব সময় আনন্দের বিষয় থাকছে না। ধানের ফলন বেশি হলে দাম কমে যাচ্ছে, ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বর্তমানে দেশে সেই দুঃখজনক অবস্থা চলছে। বোরো ধান কাটা শেষ না হতেই ধানের দাম নেমে এসেছে মণপ্রতি ৪৯৯ টাকা, অথচ গত ডিসেম্বরেই দর ছিল ৫৮০ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, সমস্ত বোরো ধান ওঠার পর দর আরও কমে যেতে পারে। অর্থাৎ বাম্পার ফসল ফলিয়ে এবার ধানচাষিদের সর্বস্বান্ত হওয়ার দশা।
এ পরিস্থিতিতে ধানের মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিত করে কৃষককে আরও ক্ষতি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সরকার দেশের চালকলের মালিকদের বিদেশে চাল রপ্তানি করার অনুমতি দিয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, চালকলের মালিকদের অনুরোধে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল রপ্তানি করা যাবে; ধারণা করা হচ্ছে, দেশে বর্তমানে এ পরিমাণ চাল উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু সমস্যা হলো দেশে এ মুহূর্তে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য চাল আছে, তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ বা নির্ভরযোগ্য হিসাব কারও কাছেই নেই।
চাল রপ্তানির ব্যাপারে এটি একটি সমস্যা, কারণ দেশের খাদ্যনিরাপত্তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত হওয়ার আগে চাল রপ্তানি করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। খোদ কৃষিমন্ত্রীর কথায়ও ঝুঁকির বিষয়টি ধ্বনিত হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, চাল রপ্তানি করার পর যদি দেশের ভেতরে চালের ঘাটতি দেখা দেয় কিংবা দাম বেড়ে যায়, তাহলে ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে।
আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, সরকারি গুদামে চালের মজুত খুব কম থাকলে, ধানের ফলন কম হলে ও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে গেলে দেশের ভেতরে চালের বাজার চড়া হয়। তখন চটজলদি বিদেশ থেকে চাল আমদানি করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিকভাবে ধান-চালের উৎপাদন কম হলে এবং তার ফলে চালের আন্তর্জাতিক বাজার চড়ে গেলে অনেক চাল রপ্তানিকারক দেশ নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি এড়াতে ও অভ্যন্তরীণ চালের বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার প্রয়াসে সাময়িকভাবে চাল রপ্তানি সংকুচিত করে, এমনকি স্থগিতও রাখে। সে রকম পরিস্থিতিতে চাল আমদানি করা সহজ ও সাশ্রয়ী থাকে না, এমনকি আমদানি করার পরও চালের বাজারে চড়া ভাব কমানো সম্ভব হয় না। ২০১৭ সালে হাওরে ফসলহানির পর সে রকম সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
তাই আমরা মনে করি, চাল রপ্তানি করার আগে সম্ভাব্য খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি খুব ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মূলত যে উদ্দেশ্যে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা হলো ধানচাষিদের ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা। ধারণা করা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে ১০-১৫ লাখ টন চাল রপ্তানি করলে তার প্রভাবে দেশের ভেতরে ধান-চালের দাম বাড়বে, কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পাবেন। আমাদের মনে হয়, এ ভাবনা বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না। ধানচাষিদের ধানের দাম উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি হওয়া বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে সম্ভব নয়, সরকারকে সেটি করতে হবে সরাসরি কৃষকের ধান কেনার মাধ্যমেই, মধ্যস্বত্বভোগী চালকলমালিকদের কাছ থেকে নয়।
বিশেষজ্ঞরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার ওপরই জোর দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার যে পদ্ধতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুসরণ করে, সেটি বেশ ফলপ্রসূ। এ ধরনের কিছু আমাদের দেশে করা যায় কি না, তা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।