রমজান মাসে বিশুদ্ধ তওবার মাধ্যমে রোজাদারের পাপমুক্তি, ক্ষমাশীলতা ও নাজাত প্রাপ্তির পথ সুগম রাখা হয়েছে। তওবার আক্ষরিক অর্থ ফিরে আসা। ইসলামি শরিয়তে এর অর্থ অতীত পাপকাজ থেকে ফিরে আসা এবং ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ়সংকল্প করা। প্রকৃত তাৎপর্য হলো আন্তরিক অনুশোচনা। অর্থাৎ, তওবা করে পাপাচার ত্যাগ করে পূর্বাবস্থায় ফিরে এসে সৎ পথে চলা। শরিয়তের পরিভাষায় শয়তানের প্ররোচনায় কোনো পাপকাজ করে ফেললে তা বুঝে আসামাত্র দুঃখিত, অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা তাৎক্ষণিক পরিত্যাগ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এই প্রতিজ্ঞা করা যে ভবিষ্যতে তা আর কখনোই করব না।
কোরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সুরার নামকরণ করা হয়েছে সুরা তওবা। এ ছাড়া সুরা নুর, সুরা তাহরিম, সুরা বাকারা, সুরা ফুরকানসহ কোরআনের আরও অনেক স্থানে তওবা এবং এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
ইস্তিগফার অর্থ হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা। সব সময় ইস্তিগফার পড়লে আল্লাহ ৫টি জিনিস দেন—১. বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, ২. টেনশনমুক্ত রাখেন, ৩. রিজিকের ব্যবস্থা করেন, ৪. কোনো আজাব দেন না, ৫. দোয়া করলে তা কবুল করেন। আসতাগফিরুল্লাহ হচ্ছে সবচেয়ে ছোট ইস্তিগফার। আসতাগফিরুল্লাহ পড়ার কারণে দোয়া কবুল হয়।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল (রহ.) শেষ বয়সে হাদিস সংগ্রহের জন্য একবার সফরে বের হয়েছেন। এক মসজিদে নামাজ পড়ে ভাবলেন, রাত এখানে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু মসজিদে থাকার অনুমতি পেলেন না। পাশেই বাজার, এক রুটির দোকানদারের কাছে বসে রাত কাটালেন। রুটির দোকানদার ছিলেন একজন যুবক। তিনি রুটির খামির বানানো, রুটি বেলা এবং উনুনে সেঁকা ও উনুন থেকে রুটি নামানোর পুরো সময়টিতে আসতাগফিরুল্লাহ বলছিলেন।
ইমাম হাম্বল (রহ.) বললেন, ‘যুবক তুমি বিড়বিড় করে কী বলো?’ যুবকটি বলল, ‘আসতাগফিরুল্লাহ আমার পছন্দের আমল। এর বদৌলতে আল্লাহর কাছে যা–ই দোয়া করি, তা কবুল হয়। একটা দোয়া এখনো কবুল হয়নি। শুনেছি এ জমানার শ্রেষ্ঠ হাদিস সংগ্রাহক হলেন ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল। যদি আমি তাঁর দেখা পেতাম।’ ইমাম হাম্বল (রহ.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমার এই দোয়াও কবুল করেছেন, আমিই আহমদ হাম্বল।’
সহিহ বুখারিতে আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন: আল্লাহর রাসুল বলেন, ‘তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবাতে তার চেয়েও বেশি খুশি হন।’
আল্লাহর দরবারে প্রকৃত রোজাদারের মর্যাদা অনেক বেশি। রোজাদারদের ওপর যেন সর্বদা আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত বর্ষিত হতে থাকে, তা–ই সারা জীবনে কৃত ভুল ও পাপ স্খলনের জন্য তওবা ও ইস্তিগফার করা একান্ত প্রয়োজন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, বিশুদ্ধ তওবা, সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৮)। ‘বিশুদ্ধ তওবা’ হলো—১. জীবনে কৃত গুনাহর জন্য অনুশোচনা করা, ২. সেই গুনাহর জন্য আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ৩. ভবিষ্যতে এসব গুনাহ না করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া।
পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তওবা গ্রহণ করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং অতিসত্বর তওবা করে। এরাই তারা, যাদের আল্লাহ ক্ষমা করেন। তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হলে বলে, “আমি এখন তওবা করছি” এবং তাদের জন্যও নয়, যাদের মৃত্যু হয় কাফের অবস্থায়’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১৭-১৮)।
নবী করিম (সা.) এমন মানুষের জন্য আক্ষেপ করেছেন, যারা রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান পেয়েও গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ তার বান্দার তওবা মৃত্যুকালীন কষ্ট শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কবুল করে থাকেন। তাই আমরা যেন ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় সব বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলে নামাজ, রোজার হুকুম-আহকাম সম্পূর্ণভাবে পালন করে তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে মাহে রমজানের অশেষ রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ করতে পারি! হে আল্লাহ! পাপকাজ করার পরপরই যাতে আপনার কাছে তওবা করতে পারি, সেই তৌফিক দান করুন!
ফেরদৌস ফয়সাল: প্রথম আলোর হজ প্রতিবেদক
[email protected]