বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী
কদিন আগে ফেসবুকে আমার বন্ধুদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম: বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা কী?
পাঁচটা সম্ভাব্য উত্তরও লিখেছিলাম: ১. গণতন্ত্রহীনতা, ২. আয়বৈষম্য, ৩. দুর্নীতি, ৪. বেকারত্ব, ৫. জনঘনত্ব। এগুলোর মধ্যে কে কোনটাকে বাংলাদেশের ১ নম্বর সমস্যা বলে মনে করেন, তা জানতে চেয়েছিলাম। উল্লেখ করেছিলাম যে এটা একটা জরিপ, সবাইকে এ জরিপে অংশ নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম।
আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে ৩০০ জন মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১৪৫ জন বলেছেন, তাঁরা দুর্নীতিকে ১ নম্বর সমস্যা বলে মনে করেন। ১০১ জন বলেছেন, বাংলাদেশের ১ নম্বর সমস্যা গণতন্ত্রহীনতা; গণতন্ত্র থাকলে অন্য সমস্যাগুলো সমাধান করা যেত। তাঁদের কেউ কেউ গণতন্ত্রের পাশাপাশি সুশাসন ও আইনের শাসনের কথা বলেছেন। দু-একজন বলেছেন, সুশাসন থাকলে গণতন্ত্র ছাড়াও দেশের উন্নয়ন হতে পারে। ৩৫ জন বলেছেন, তাঁরা জনঘনত্বকে বাংলাদেশের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে দেখেন। জনঘনত্বই বাকি সব সমস্যার জন্ম দিয়েছে—এমন মন্তব্যও কেউ কেউ করেছেন। ১০ জন বলেছেন, ১ নম্বর সমস্যা আয়বৈষম্য। ৫ জন বলেছেন, বেকারত্বই ১ নম্বর সমস্যা।
মন্তব্যকারীদের মধ্যে বেশ কজন বলেছেন, উল্লিখিত পাঁচটি সমস্যার সব কটিই তাঁরা বাংলাদেশের জন্য গুরুতর বলে মনে করেন। একজন রসিকতা করে বলেছেন, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’। আরেকজনের মন্তব্য, ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি!’ কেউ কেউ বলেছেন, আমার উল্লিখিত পাঁচটি
সমস্যার বাইরে আরও অনেক গুরুতর সমস্যা আমাদের দেশে আছে।
এত অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে এভাবে জরিপ চালিয়ে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যদিও ঠিক নয়, তবু দুর্নীতি (১৪৫) আর গণতন্ত্রহীনতার (১০১) ভোটের মধ্যকার পার্থক্য দেখে এমন ধারণাই প্রকট হলো যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই হয়তো দুর্নীতিকে এ দেশের প্রধানতম সমস্যা বলে মনে করে। অবশ্য ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সমাজের শিক্ষিত, মোটামুটি সচ্ছল অংশের প্রতিনিধি, গোটা সমাজের নয়। অক্ষরজ্ঞানহীন, নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তাঁদের মধ্যে এই বিষয়ে কে কী ভাবছেন, সেটাও অবশ্যই খতিয়ে দেখার বিষয়। কিন্তু সেটা করার উপায় আমার নেই। আমি ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ১৫ জন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বললাম। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য যে পাঁচটি সমস্যা উল্লেখ করেছিলাম, রিকশাচালকদেরও সেগুলো বললাম। ১০ জন রিকশাচালক বললেন, পাঁচটি সমস্যাই গুরুতর, কোনটার আগে কোনটা বলবেন, তা নিয়ে প্রত্যেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেন। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে তিনজন নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন। তাঁদের একজন বললেন, এ দেশে এখন আর ‘অরজিনাল ভোট হইতেছে না।’ আর একজন হেসে বললেন, ‘ইলেকশন মশকারি হইয়া গেছে।’ একজন বললেন, পাপ বেশি হয়ে গেছে, কেউ আল্লাহর হুকুম মানছে না। একজন বললেন, ‘রাজনীতিবিদেরা খারাপ হয়া গেছে।’ আর একজনের মন্তব্য, ‘এই দেশে এখন চুরি-দুর্নীতি ছাড়া আর কিছু নাই।’
এই রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি যানজটের প্রসঙ্গ তুলিনি; তাঁদের মধ্য আটজন নিজে থেকেই বললেন যে তাঁদের জন্য অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা ঢাকার যানজট, যানজটের কারণে তাঁদের আয় কমে যাচ্ছে, ঝক্কি-ঝামেলা বাড়ছে। তিনজন বললেন, তাঁদের ওপর ট্রাফিক পুলিশের ‘জুলুম’ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। যানজটের কারণ যে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, এটা আমি ধরিয়ে দিলে তাঁদের কেউ বললেন, ঢাকায় লোক বেশি হবে না তো কোথায় বেশি হবে, রাজধানী বলে কথা। কেউ বললেন, জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে, মানুষের ঘরে সন্তানসন্ততির জন্ম হবে, এটাই স্বাভাবিক। লোকসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, সেই কারণে দেশের এত সমস্যা—আমি এই কথা বললে রিকশাচালকদের অধিকাংশই আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন।
আসলে আমি ফেসবুকে জরিপটা চালিয়েছিলাম এই কৌতূহল থেকেই: আমার ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে কত শতাংশ মনে করেন যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা এর অতিরিক্ত জনঘনত্ব? দেখা গেল, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম, ৩০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৫ জন। এ দেশের সরকারি নীতিনির্ধারকেরাও মনে করেন না যে জনঘনত্ব আমাদের কোনো সমস্যা। তাঁদের কেউ কেউ বড় জনসংখ্যাকে বলেন সম্পদ। অর্থনীতিবিদদের একটা অংশ বলেন, বড় জনসংখ্যা অর্থনীতিকে বেগবান করে। আমাদের দেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিবার ছোট রাখার উদ্দেশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার করতে চান কিন্তু সহজে পান না, এমন দম্পতি অনেক। গত বছর মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকটের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও জনসংখ্যার আধিক্য সমস্যা হিসেবে তেমন আলোচিত হয় না। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল শেপার্স সার্ভেতে অংশগ্রহণকারী ১৮৬টি দেশের ৩১ হাজার নারী-পুরুষ (যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর, যাঁদের বলা হয় ‘মিলেনিয়ালস’ বা সহস্রাব্দ প্রজন্ম) পৃথিবীর প্রধান ১০টি সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন। ১ নম্বরে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, ৪৮ শতাংশ নারী-পুরুষের বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনই পৃথিবীর প্রধানতম সমস্যা। তাঁদের মধ্যে ৯১ শতাংশ বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডের দায় আছে। তাঁদের ৭৮ শতাংশ বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা থামানোর জন্য তাঁরা নিজেদের জীবনযাপনের ধরন (লাইফস্টাইল) বদলাতে রাজি আছেন।
ওই জরিপে দ্বিতীয় বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল যুদ্ধবিগ্রহ (৩৮.৯ শতাংশের মতে), তৃতীয় সমস্যা অসমতা (আয়বৈষম্য, ৩০.৮ শতাংশ)। চতুর্থ সমস্যা দারিদ্র্য (২৯.২ শতাংশ); পঞ্চম সমস্যা ধর্মীয় সহিংসতা (২৩.৯ শতাংশ)। ৬ নম্বরে স্থান পেয়েছিল শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, সরকারি দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতার ঘাটতি ও দুর্নীতি (২২.৭ শতাংশ)। ৭ নম্বরে খাদ্যনিরাপত্তা, নিরাপদ পানির সংকট (১৮.২ শতাংশ); ৮ নম্বরে শিক্ষার অভাব (১৫.৯ শতাংশ); ৯ নম্বরে নিরাপত্তাহীনতা, সুরক্ষার অভাব (১৪.১ শতাংশ) এবং ১০ নম্বরে অর্থনৈতিক সুযোগ বা কর্মসংস্থানের অভাব, অর্থাৎ বেকারত্ব (১২.১ শতাংশ)।
বৈশ্বিক ১০টি সমস্যার তালিকায় ওভার পপুলেশন বা অতিরিক্ত জনসংখ্যার স্থান হয়নি—এর কারণ কী হতে পারে? এটা কি পৃথিবীর জন্য আদৌ কোনো সমস্যাই নয়?
জাতিসংঘের হিসাবে পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৭৬০ কোটি। ১৯৫০ সালে ছিল মাত্র ২৬০ কোটি। অর্থাৎ গত ৭০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৫০০ কোটি বেড়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১১—এই ১২ বছরেই বেড়েছে ১০০ কোটি। বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ মনে করে, পৃথিবীর জন্য ৫০০ কোটি লোকই অনেক বেশি। কেউ কেউ তো মনে করেন, পৃথিবীর লোকসংখ্যা ২৬০ কোটি পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে এই গ্রহের ফতুর হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রতি আটজন মানুষের একজন প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২১০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে এবং এই সংকট ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ৪৫০ কোটি মানুষের স্যানিটেশন নেই। স্টিফেন হকিং মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বলে গেছেন, মানুষ অচিরেই পৃথিবীকে সম্পূর্ণভাবে ফতুর করে ফেলবে, এই ধরিত্রী আর মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে, নির্মল পানি-বায়ু দিয়ে লালন-পালন করতে পারবে না। তাই মানব প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলে মহাশূন্যে মাইগ্রেট করতে হবে।
এসব অনেক বড় সমস্যা। বাংলাদেশে আমরা অ্যাডহক জীবনযাপন করি, দিনের সমস্যা ছাড়িয়ে আমাদের দৃষ্টি বেশি দূরে যেতে পারে না। আমরা যেসব সমস্যাকে সমস্যা বলে অনুভব করি, পীড়িত হই, সেগুলো খুবই প্রত্যক্ষ, একদম আশু, এই মুহূর্তের, প্রতি মুহূর্তের সমস্যা। দুর্নীতি সত্যিই আমাদের পীড়িত করে; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব, আইনের শাসনের গুরুতর অবনতি, কর্মসংস্থানের অভাব, আয়ের বৈষম্য—এগুলো আমাদের জন্য তাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্কের বিষয় নয়, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার অংশ। আমার মনে হয়, এই সব এবং আরও অনেক সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে আমাদের জনঘনত্ব ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার ফলে। অনেকে এই কথা মানতে চান না; তাঁরা বলেন, ‘ম্যানেজ করতে পারলে জনঘনত্ব কোনো সমস্যা নয়।’ কিন্তু জনঘনত্ব যদি এত বেশি হয় যে তা আর সহজে ম্যানেজেবল থাকে না, তাহলে কি ম্যানেজ করার কথা বলার কোনো অর্থ থাকে?
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৭০ লাখ। চীন ও ভারতের তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু আমাদের দেশটা খুবই ছোট, তাই আমাদের জনঘনত্ব চীন ও ভারতের জনঘনত্বের চেয়ে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪৫ জন মানুষ বাস করে, ভারতে ৩৮২ জন। কিন্তু বাংলাদেশে ১ হাজার ১২৫ জন! এতটুকু ভূখণ্ডের মধ্যে এত বেশিসংখ্যক মানুষকে ভালোভাবে ম্যানেজ করা প্রায় অসম্ভব, উপরন্তু আমাদের ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি বা ম্যানেজমেন্ট কালচার অত্যন্ত দুর্বল। সুশাসনের ঘাটতি, আইনের শাসনের দুর্বলতা, দুর্নীতি, পরিবেশ বিপর্যয়, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস, অপরাধবৃত্তি— এমন অজস্র সমস্যা আমরা কীভাবে সমাধান করব, যদি অতিরিক্ত জনঘনত্ব সামলাতে না পারি?
মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক