'ধর্ষণের অভিযোগ মামলায় নেই কেন?'
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন মহল থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে ‘নির্বাচনটি’ যেমনই হোক না কেন, এবার সরকার মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূল, দুর্নীতি উচ্ছেদ, দলীয় মাস্তানি বন্ধ এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কোনো আপস করবে না। অর্থাৎ তারা নির্বাচনের ঘাটতিটা উন্নয়ন ও সুশাসন দিয়ে পূরণ করে নেবে। কথাটি সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও কারও কারও মনে ক্ষীণ আশা জেগেছিল, বাংলাদেশে অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে।
কিন্তু গত সাড়ে তিন মাসের হিসাব নিলে সুশাসনের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও নীতি-নৈতিকতার যে মারাত্মক অবনতি ঘটে চলেছে, তাতে কোনো সচেতন নাগরিকই বিচলিত ও বিমর্ষ না হয়ে পারেন না। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক বিন্যাসটি এমনভাবে পাল্টে দিয়েছে যে কোনো দল বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ন্যূনতম আস্থা রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় কোন্দল ও নেতা-কর্মীদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস চরমে পৌঁছেছে।
নির্বাচনের অব্যবহিত পর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে বাসায় ঢুকে স্বামীকে বেঁধে এবং সন্তানদের অন্য ঘরে আটকে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। ওই নারীর অপরাধ, তিনি বিএনপির সমর্থক এবং ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। ধর্ষকেরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নির্দেশে তাঁরা এই কাজ করেছেন। এরপরও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।
এই অস্বীকৃতি যে পরবর্তী অপরাধকে উৎসাহিত করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ৩১ মার্চের উপজেলা নির্বাচনে। ধর্ষণের শিকার নারীর অভিযোগ অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে তিনি ও তাঁর স্বামী চশমা প্রতীকের ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তাজউদ্দিন বাবরের সমর্থনে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। সন্ধ্যায় স্বামীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে তালা প্রতীকের প্রার্থী এবং নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহারের সমর্থক ইউসুফ মাঝির নেতৃত্বে ১০-১২ জন উত্তর বাগ্যা গ্রামের রুহুল আমিনের মাছের খামারের কাছে তাঁদের মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে মারধর করেন এবং বেচু মাঝি, বজলু ও আবুল বাসার তাঁকে মাছের খামারের পার্শ্ববর্তী কলাবাগানে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ওই নারী ছয় সন্তানের জননী।
আগে নির্বাচনী বিরোধের জের ধরে মারপিট হতো, প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা হতো। মানুষ খুন হতো। এখন নারীরা ধর্ষিত হচ্ছেন। সুবর্ণচরের তৃতীয় ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে এক বেবিট্যাক্সিচালক, স্কুলছাত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টার শিকার আরেক নারী অপমান সইতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। অথচ পুলিশ যে মামলা করেছে, তাতে ধর্ষণের কথা নেই। গত মঙ্গলবার এ–সংক্রান্ত রিটের শুনানিকালে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগ মামলায় নেই কেন?
আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিদিন দেখছি দেড় বছরের শিশু থেকে ছয় সন্তানের জননী পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এদিকে ফেনী জেলার ফুলগাজী আলিম মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার প্রধান হোতা ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। এই লোকের হাতে এর আগে বহু ছাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেননি। নুসরাত প্রতিবাদ করেছেন। গভর্নিং বডির কাছে নালিশ করেছেন। প্রতিকার না পেয়ে তিনি থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর অধ্যক্ষ কারাগারে বসেই নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং দলীয় মাস্তানদের দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। একদা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সিরাজ উদদৌলা এখন আওয়ামী লীগের খাস পেয়ারের মানুষ। আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মকসুদুল আলম প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছেন শাহাদত। নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এখানে খুনিকে রক্ষায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক এক গডফাদারের ইঙ্গিত করে লিখেছে, ‘স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনসহ এলাকার প্রভাবশালীরা ওই গডফাদারের ইচ্ছার বাইরে যেতে পারেন না। ওসি মোয়াজ্জেম চলতেন ওই গডফাদারের আশীর্বাদে। যৌন নির্যাতনের ঘটনায় নুসরাত গভর্নিং বডির কাছে বিচার চাইলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি গডফাদারের নির্দেশনায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। নুসরাতের যৌন নিপীড়নকারী অধ্যক্ষের পক্ষে অবস্থান নেয় গভর্নিং বড়ির সদস্যসহ কথিত গডফাদার।...জামায়াতের নেতা হয়েও অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা দোর্দণ্ড প্রতাপে তাঁর অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এটি সম্ভব হয়েছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা-কর্মীকে মাসোহারা দিয়ে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ এপ্রিল ২০১৯)
এ ব্যাপারে ফুলগাজী থানা-পুলিশের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। মামলা করার সময় নুসরাত যেসব কথা বলেছেন, তার অডিও তারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে পুলিশ সুপার পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন, নুসরাতের পরিবার মামলার বিষয়ে ওসিকে সহায়তা করেনি। যে ওসি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁকে পরিবার কেন সহায়তা করবে? পরিবার অনড় ভূমিকা না নিলে এবং মৃত্যুর আগে হাসপাতালে নুসরাত জবানবন্দি দেওয়ার সুযোগ না পেলে, আরও অনেক হত্যার ঘটনার মতো নুসরাতের হত্যাও পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিত।
শুধু নোয়াখালী বা ফেনী নয়, সারা দেশেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিংবা অন্য কোনো অপশক্তির মদদে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৭ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৯টি শিশু।
১৭ এপ্রিল প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, শুক্রবার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সাত জেলায় ১২টি নারী ও শিশু ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এর পরদিনই খবর বের হলো, প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় গাজীপুরে খুন হয়েছে এক কলেজছাত্রী। বখাটেদের উপদ্রব সইতে না পেরে বরিশাল ও গাজীপুরে দুই ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। ডেমরায় এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তিন লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে এক শিশুকে হত্যা করেছেন।
এর পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনটির দৌরাত্ম্যও বেড়ে চলেছে। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায় উপদলীয় কোন্দলের কারণে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএসের সমর্থকেরা এই কনসার্টের আয়োজন করলেও সংগঠনের সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এর প্রতিবাদে সভাপতির সমর্থকেরা অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল ও সাউন্ড সিস্টেম, মাইক ইত্যাদি পুড়িয়ে দেন। অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ বলেছে, এতে তাদের ৪০ লাখ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। একই দিন সিলেটের মদন মোহন কলেজে ছাত্রলীগের নববর্ষের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। এতে দুজন শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পাঁচজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
আইনের শাসনের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রে সরকারি দলের লোকজন আইনের গতি থামিয়ে দিচ্ছেন বা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনও অপরাধীদের না ধরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা করছে। গত বছর আগস্টে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে যে শিক্ষার্থীরা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিল, তাদেরই একাংশকে এখনো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়ে প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আর যারা হেলমেট পরে লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদেরও ওপর চড়াও হয়েছিল, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]