কোনো কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই রেশ যায় না; তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থাকে অনেক দিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক-এগারো বা ২০০৭-০৮ সাল পর্বের পরিবর্তন সে রকমই একটি ঘটনা। এই ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছেন, যাঁরা লাভবান হয়েছেন এবং যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—এই তিন পক্ষ নিজেদের তৈরি চশমা দিয়ে দেখেছেন, সুবিধামতো ব্যাখ্যা করেছেন এবং এখনো করছেন।
এক-এগারো নিয়ে এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে লিখলেও সামগ্রিক বিষয়টি তুলে ধরেছেন লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। এ বইয়ে তিনি নিজের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন সেই সময়ের প্রধান চরিত্র, পার্শ্বচরিত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা একে অপরের বক্তব্য খণ্ডন করেছেন। এর মাধ্যমে পাঠক সত্যাসত্য বিচার করতে পারবেন। লেখকের ভাষায়: এই বইয়ে বিশেষ একটি সময়ের যে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তার বড় একটি অংশ সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমি চেয়েছি খোলামেলা আলোচনার মধ্য দিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে।...দেখা গেছে, একই বিষয়ে একেকজন একেক রকম তথ্য দিয়েছেন বা মন্তব্য করেছেন। আবার কিছু কিছু বিষয়ে একমত পেয়েছি। এই ভিন্নতাটুকু সময়ের চরিত্রগুলো বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।’
মহিউদ্দিন আহমদের লেখায় তিনটি পর্ব উঠে এসেছে; এক-এগারোর পটভূমি, সেনাসমর্থিত সরকারের দুই বছরের শাসন এবং পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। প্রথমেই স্বীকার করতে হবে যে বিষয়টি রাজনৈতিক এবং রাজনীতিকেরাই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন।
যেকোনো ঘটনার পটভূমি, শুরু এবং শেষ থাকে—কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক-এগারো এমন এক ঘটনা, যা সহজে শেষ হওয়ার নয়। যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে এক-এগারো ঘটানো হয়েছিল বলে এর উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, যা নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে আশাবাদ জেগেছিল, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনীতি এক কদমও এগোয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে আরও ভঙ্গুর, অকার্যকর।
বলা হয়ে থাকে, রাজনীতি ও শাসনকাঠামো সংস্কারই ছিল এক–এগারোর লক্ষ্য। তার আগে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নসহ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। এক-এগারোর আগে ক্ষমতায় ছিল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নামে তত্ত্বাবধায়ক হলেও কার্যত সেটি ছিল বিএনপি সরকারের বর্ধিত সংস্করণ। ফলে বিএনপি জোটের বাইরের প্রায় সব দল ক্ষমতার পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিল। ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে চারদলীয় জোট ছাড়া সব দলের নেতা-নেত্রীরা সোৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন।
এক-এগারোর কুশীলবেরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, শুরুতে তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে নিজেদের একটা বিকল্প শক্তিকেন্দ্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিলেন, যা ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন পরিচালক চৌধুরী ফজলুল বারীর জবানিতে উঠে এসেছে। যদিও তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের দাবি, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ নেত্রী যখন গ্রেপ্তার হলেন, তখন রাজনীতিকদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি তৈরি হয়। দুই দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নিজেদের সংস্কারবাদী বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন। অন্যরা থেকে গেলেন নিজ নিজ নেত্রীর সঙ্গেই। আবার কেউ কেউ দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছিলেন।
কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা, বিশেষ করে সেই সময়ে হঠাৎ করে চালের ঘাটতি, নিত্যপণ্যের মূল বৃদ্ধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কুশীলবদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়; যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ এক-এগারোর পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল, তারাও অনির্বাচিত সরকারকে বেশি দিন মেনে নিতে চায়নি। তদুপরি কয়েক মাস না যেতেই এক-এগারোর দুই প্রধান কুশীলব মইন উ আহমেদ ও মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, যার পরিণতিতে শেষোক্তজন দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর সহযোগীরাও ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েন। এই প্রেক্ষাপটে মইন উ আহমেদ ক্ষমতা ধরে রাখার চেয়ে মসৃণ প্রস্থানের উপায় খুঁজতে থাকেন। আর সে ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকেই তিনি নিরাপদ উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ভারত সফরকালে দেশটির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী (পরবর্তী কালে রাষ্ট্রপতি) প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথোপকথনটি স্মরণীয়। প্রণব মুখার্জি দুই নেত্রীকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিলে মইন উ আহমেদ ক্ষমতা ছাড়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এই নিশ্চয়তা চান। প্রণব মুখার্জির ভাষ্য অনুযায়ী, মইন নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন।
এক-এগারোর চরিত্র উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এর অন্যতম কুশীলব মইন উ আহমেদের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেই সময়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক চৌধুরী ফজলুল বারীরও। তাঁরা
সত্য বলেননি, নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। একই কাজ করেছেন সে সময়ের আলোচিত রাজনীতিকেরাও।
মহিউদ্দিন আহমদ আরও যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও উপদেষ্টা মইনুল হোসেন, সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান সারোয়ার জাহান নিজাম, সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান ও নুরউদ্দিন খান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এ টি এম জহিরুল আলম, রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মাহমুদুর রহমান মান্না, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান, শিক্ষকনেতা হারুন অর রশিদ ও সদরুল আমিন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ইফতেখারুজ্জামান, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আবুল হাসিব খান, সাবেক আইজিপি খোদা বকশ চৌধুরী, র্যাবের সাবেক ডিজি মিজানুর রহমান, চিকিৎসক কাজী মজহারুল ইসলাম প্রমুখ। লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর সময়ে তিনি এই সাক্ষাৎকারগুলো নিয়েছেন। একটি বইয়ের জন্য এতজন মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
ফখরুদ্দীন আহমদ নিজেকে সরকারের দৈনন্দিন কাজ ও নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে নিজেকে জড়াননি। কিন্তু তাঁর কোনো কোনো উপদেষ্টা জড়িয়েছেন কিংবা দূরবর্তী লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন, তার আভাস-ইঙ্গিতও মহিউদ্দিনের বইয়ে আছে।
রাজনৈতিক সংকট বা অচলাবস্থার সুযোগে এর আগেও বাংলাদেশে সেনা হস্তক্ষেপ হয়েছে; সে সময়ে তাদের সাফল্যের বড় কারণ ছিল জনপ্রিয় শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতি। প্রথমবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়; দ্বিতীয়বার জিয়া হত্যার কয়েক মাস পর এরশাদ প্রায় বিনা বাধায় বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। এক–এগারোর কুশীলবেরা যেসব তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন, তাতে বলা যাবে না যে এর পেছনে দীর্ঘ ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল। তাঁরা দুই শীর্ষ নেত্রীকে বাদ দেওয়ার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু এরপর কী করবেন সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এক-এগারোর উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক না কেন, সেসব কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা তাঁরা জানতেন না। তাঁরা যেসব সংস্কারের কথা বলেছিলেন, কার্যত তার কোনোটিই সফল হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলে তাঁরা ক্ষমতায় এলেও তাঁদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। সেখানে পক্ষপাত ছিল। ফলে লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে না তুলেই এক–এগারোর কারিগরদের সটকে পড়তে হয়েছে।
ইতিহাসের কৌতুক হলো, যাঁরা এক-এগারো থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা তো বটেই, যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁরাও এর বিরুদ্ধে পরবর্তী কালে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু সে সময়ে কোন দলের কোন কোন নেতা এক–এগারোর কুশীলবদের সঙ্গে বৈঠক ও সমঝোতা করেছেন, সেসব মহিউদ্দিন আহমদ ফাঁস করে দিয়েছেন।
এক-এগারো প্রথাগত গবেষণামূলক বই নয়। এটি এমন আঙ্গিকে লেখা হয়েছে, যা পড়তে সব শ্রেণির পাঠক আগ্রহী হবেন। এতে গবেষক যেমন তাঁর গবেষণার খোরাক পাবেন, তেমনি ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু পাঠক এক–এগারোর অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন।
এক-এগারোর পরিবর্তন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারেনি, পিছিয়ে দিয়েছে বহু বছর। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোনালি অধ্যায় হয়নি; যা হয়েছে অন্ধকার আবছায়া, যে ছায়ায় এ দেশের মানুষকে হয়তো আরও বহুদিন কাটাতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ সাধুবাদ পেতে পারেন এ কারণে যে তিনি এক–এগারোর কলাকুশলীদের ভাষাতেই ইতিহাসের সত্য পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন। বইটির সুপ্রচার কামনা করি।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]