১০ মার্চ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি গোলটেবিল সংলাপে বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রণীত ‘বিশেষ বিধান আইন’ বাতিল করে সরকারি ক্রয়নীতি (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস—পিপিআর) অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ, এই বিশেষ বিধানের অপব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সংলাপ অনুষ্ঠানের সভাপতি অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ভাষায়, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের দরপ্রক্রিয়া, উৎপাদন, সরবরাহ ও
মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা উচিত। কেননা প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে এসব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন।’ সংলাপে বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ খাতের ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিলের তাগিদই দিয়েছেন ‘বিশেষ বিধান’ বাতিলের দাবির মাধ্যমে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের মহাসংকট কাটিয়ে উঠতে জরুরি ভিত্তিতে মহাজোট সরকার স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় যে অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছিল, সেগুলোর উদ্যোক্তা বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় অস্বাভাবিক রকমের বেশি ধরা হয়েছে বলে ওগুলোর নির্মাণপর্বেই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল ব্যবহারকারী এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৪-১৬ টাকা। এই উদ্যোক্তাদের বাছাই প্রক্রিয়া যেহেতু আশু সংকট নিরসনের যুক্তিতে নিয়মানুগ টেন্ডার পদ্ধতিতে হয়নি, তাই এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলার মাধ্যমে আইনের প্রয়োগ ঠেকানোর জন্য একটা ‘দায়মুক্তির আদেশ’ জারি করা হয়েছিল। সেটা ১০ বছর পর এখনো বহাল রাখা হয়েছে কী যুক্তিতে?
উপরন্তু এ ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি এখনো অব্যাহত রয়েছে তা হলো বিদ্যুতের বিক্রয় দামের দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন খরচ পড়া সত্ত্বেও অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট থেকে সরকার কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত বিদ্যুৎ ক্রয়ের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ওই প্ল্যান্টগুলো থেকে দ্বিগুণ দামে এখনো বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। অথচ কথা ছিল পাঁচ বছরের বেশি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করা হবে না। ওই সময়ের মধ্যে মধ্যমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন শুরু করবে বলা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রায় সব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের মালিক তাঁদের কেন্দ্র থেকে পিডিবি যাতে বিদ্যুৎ ক্রয় অব্যাহত রাখে, তদবির করে সেই ব্যবস্থা নবায়ন করে চলেছেন। এই তদবির–প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অভিযোগটা যে অমূলক নয়, তা বোঝা যায় এই দ্বিগুণ দামে বিদ্যুৎ কেনার জন্য সরকারি খাতের দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অযৌক্তিকভাবে বন্ধ রাখায়। এর খেসারত দিতে হচ্ছে জনসাধারণকে, কারণ কিছুদিন পরপর লোকসানের অজুহাতে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে। বিদ্যুতের মহাসংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য মহাজোট সরকারকে সাধুবাদ দিতে হয়, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও স্মরণ করা উচিত যে এই সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুঁজি লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞ।
উল্লেখ্য, ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ওই পাঁচ বছরে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন টঙ্গীর ‘পিকিং প্ল্যান্ট’ ছাড়া আর এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। এই চরম ব্যর্থতার ফলে ২০০১ সালে যেখানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, তার তুলনায় ২০০৯ সালে যখন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গিয়ে মাত্র ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, ওই সময়কালে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। ওই সময়ের ভয়াবহ লোডশেডিং জনজীবনে কী দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল এবং অর্থনীতিকে কীভাবে জিম্মি করে রেখেছিল, তা ভুলে যাওয়া কঠিন। স্বস্তির বিষয়, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার ফলে গত ১২ বছরে বাংলাদেশ এই গুরুতর বিদ্যুৎ–সংকট কাটিয়ে উঠেছে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু মহাজোট সরকারের আমলে গৃহীত প্রতিটি প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পগুলোর চূড়ান্ত ব্যয় বিশ্বের মধ্যে ‘সর্বোচ্চ প্রকল্প ব্যয়ের’ তকমা পেয়ে যাচ্ছে। ঢাকার মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ‘প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ’ (পিপিপি) প্রকল্পের অধীনে। ওই প্রকল্পের চূড়ান্ত খরচ প্রাক্কলিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেড়েছে। এভাবে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে ফ্লাইওভার ও সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ। মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর নির্মাণব্যয় বৃদ্ধির অজুহাতে টোলহার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং জনগণকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সম্পন্ন ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতিটি উড়ালসড়কের নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলিত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি হয়েছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের কারণেই।
ঢাকা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। মানে, এই এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়াবে ৭০৪ কোটি টাকা। এটা বিশ্বে এ রকম প্রকল্পের জন্য কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে নির্মীয়মাণ ৩০ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যয় পড়ছে কিলোমিটারপ্রতি ২০৭ কোটি টাকা। আর ভারতের বেঙ্গালুরুর ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ হোসুর রোড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিলম্বের কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরও প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়েছে ২০৩ কোটি টাকার মতো।
আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কিলোমিটারপ্রতি ৭০৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত নির্মাণব্যয়কে ‘ভীষণ রকমের অস্বাভাবিক’ অভিহিত করে বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, ‘অবকাঠামোগত কিছু পার্থক্য থাকলেও ভারত, ভিয়েতনাম, চীন, হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২০০-২৫০ কোটি টাকার মধ্যে থাকে।’ এর তুলনায় কিলোমিটারপ্রতি ৭০৪ কোটি টাকা ব্যয়-বরাদ্দ যে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের ‘অস্বাভাবিক’ চাহিদা মেটানোর জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
জনগণের স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকারকে সুশাসন কায়েম করতেই হবে এবং দুর্নীতি দমনে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। ১০ বছর ধরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক প্রশংসনীয় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, কিন্তু দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে সরকার সরে এসেছে বলে কোনো বিশ্বাসযোগ্য সুখবর পাওয়া যায়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন প্রতিটি শাসক মহল এ ধরনের ‘স্বজনতোষী পুঁজিবাদেরই’ পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। বিদ্যুৎ খাতের ‘দায়মুক্তির আদেশ’ বাতিলের আহ্বানটি আসলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণাকে কাজে পরিণত করারই আহ্বান।
ড. মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ