কবরীর আত্মস্মৃতি
তাঁর কথা তিনি নিজেই বলেছেন। ফ্রক পরা কিশোরী মিনা পালই আমাদের জীবনস্মৃতিতে একটি উজ্জ্বল তারকা। তাঁর অভিনয় যে একবার দেখেছে, চিনে নিয়েছে বাঙালির রুচির শ্রেষ্ঠ একটি স্থিরচিত্রকে, যিনি চলচ্চিত্রে তাঁর স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
গতকাল রাতে বোন ফেরদৌসীকে (কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান) দেখতে গিয়েছিলাম। তঁার টেবিলে রাখা একটি বই। স্মৃতিটুকু থাক, লেখক কবরী। কাল রাতেই পড়া শেষ। আর আজ লিখতে বসলাম। বইটি পড়ে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে। কবরীকে কোনো দিন বলতেই পারিনি তাঁর অভিনয় কীভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে প্রভাবিত করেছে, যেমনটি করেছিলেন সুচিত্রা সেন। আমি তাঁকে টেলিফোন করেও আমার মুগ্ধতা জানাতে পারতাম। কিন্তু আমি একজন ক্ষুদ্র লেখক। তাঁকে আমার এই ভালোবাসাটুকু অক্ষরের বৃত্তে বন্দী করে রাখলাম। এই কারণে যে পেয়ারাগাছের ডালে যখন তিনি এক পা, দু–পা করে ওপরে উঠছেন একটি ডঁাসা পেয়ারার লোভে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত রঞ্জন সেনের মাঠে সবুজ ঘাস, ঘাসডুবো জল ও একা, তাকে আমি দেখেছি। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় নিয়ে গেছে চিত্রপুরীতে, যেখানে তিনি জননন্দিতা, সেই প্রথম দিনের, ১৯৬৪ সালের সুতরাং থেকে ২০০৪ সালের প্রেমবন্ধন পর্যন্ত। তাঁর অভিনীত সব ছবি দেখিনি। মনেও নেই। মনে আছেন কবরী।
নির্মলেন্দু গুণের ভক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তিনি যখন লিখেছেন মাত্র কয়েক লাইনের ‘পূর্বলেখ’, মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। কবরীকে এর চেয়ে জীবন্ত করে আর কেউ উপস্থাপনা করতে পারে, তা বিশ্বাস করি না। এখানে তিনি লিখেছেন সুচিত্রা সেনকে নিয়ে তাঁর একটি কবিতার কথা। সেটা পাঠযোগ্য এবং মনে রাখার মতো। কবরীকে নিয়ে যা লিখেছেন তা লিখব আমি। তা হলো, বাংলার মানুষের হৃদয়ে যে কিশোরী চিরদিন স্থান পেয়েছে, যা কোনো দিন ম্লান হবে না, তার নাম কবরী। তার কণ্ঠস্বর, তার দেহপট, তার কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই প্রতিনিধিত্ব করে গ্রামবাংলার সৌন্দর্যকে। তার চোখ তার মনের কথা বলে। তার ছুটে চলা, তার গান গাওয়া, তার নৃত্যভঙ্গি মিশে আছে বাংলার প্রতিটি গ্রামের কিশোরীর ছত্রচ্ছায়ায়। ভোলা যাবে না তার অমলিন হাসি। ভোলা যাবে না তার অভিনয়ের সারল্য। দিলীপ কুমার অবশ্যই বলেছিলেন, কবরী, তুমি সবগুলো পার্বতীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী।
তাঁর মধ্যে রাজনীতির স্বপ্ন অবশ্যই ছিল। সে স্বপ্নকে কবরী বলেছেন: স্বপ্নভঙ্গ বড় বেদনার। মুহাম্মদ ইউনূস একটা চাটগাঁইয়া গান গেয়ে উঠেছেন কবরীকে দেখে। সেটি: ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান দইজ্যার কুলোত/বসত করি সিনাডি ঠেকাই ঝড় তুফান’।
কোন জায়গা থেকে শুরু করব? এঁরা যে সবাই আমার বড় আপন। এঁদের সবাইকে নিয়ে আমি লিখতে পারব। যেমন রাজ্জাক। পরিণত বয়সে গুলশানের আজাদ মসজিদে তৃতীয় সারিতে তিনি। আর প্রথম সারিতে ঠিক ইমামের পেছনে এই অধম। একদিন রাজ্জাক আমাকে কানে কানে বললেন, প্রথম সারিতে কিছু নেই। চেষ্টা করুন প্রভুকে বুকের মধ্যে সন্নিবেশিত করতে। শেষ সারিতে হলেও সই। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে আবার মসজিদে দেখা। আমাকে বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি বললাম, না ভাই, পারছি না। প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ের রংটা রোদে পুড়ে গেছে। বললেন, আমি রাজ্জাক। আমি অবাক। এখন ভাবি, সর্বজনের হৃদয়ে যে কবরী, তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে সফল অভিনেতা রাজ্জাক। কোথায় হারিয়ে গেলেন রাজ্জাক?
স্মৃতির মধ্যে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের তুলে আনা বড় কষ্টকর। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পাওয়ার দিন কবরীর আরেক চেহারা। কক্সবাজারে একটি লম্বা গাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবরীর লম্বা হওয়ার প্রচেষ্টার কী সুন্দর অভিব্যক্তি। তাঁর পরিচয় পাতায় পাতায় ছবিসহ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কবরীর রাজপথে ছুটে আসা অথবা তাসখন্দ শহরের চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর উপস্থিতি, সে এক বিস্ময়। তিতাসপারের কবরীকে খুঁজে বের করেন ঋত্বিক ঘটক। স্বাধীনতার পর সিনেমা জগতে আসে নতুন মাত্রা। আগে আসত শুধু পারিবারিক গল্প। পরে আসে আধুনিকতার স্পর্শ, যেখানে ভায়োলেন্স, সেক্স। শূন্যস্থানে যিনি রানির মাহাত্ম্য বিস্তার করেছেন/আমগাছের ঝরা মুকুল, কোকিলের কুহুতান, জোছনামত্তা যামিনী, তিনিই কবরী। পারিবারিক জীবনে তাঁকে দেখার খানিকটা সুযোগ অবশ্যই হয়েছিল। তাঁর স্বামী আমার বন্ধু। কবরীর সৌন্দর্য তাঁর অকৃত্রিম সরল ব্যবহার। আমাদের শিল্প ভুবনে এর চেয়ে সুন্দর আত্মজীবনী আর কেউ লিখেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। এত সুন্দরভাবে তাঁর গল্প এগিয়ে চলেছে যে কেউ একটি মুহূর্তের জন্যও থামবে না। এই বইটি আমাদের শত টানাপোড়েনের জীবনেও একটি মহৎ ছবি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব