ভারতের বিমানবাহিনী ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা আদতে কী করেছিল তা নিয়ে আগামী কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিস্তর বিশ্লেষণ চলবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার ধরন, ব্যাপ্তি ও সাফল্য নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া চলতে থাকবে।
ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এই হামলাকে ভেতরে-ভেতরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাটক মনে করলেও প্রকাশ্যে তারা সবাই এ কথা বলছে না। এর কারণ হলো, সারা দেশেই পুলওয়ামা হামলার বদলা নেওয়ার জোর দাবি উঠেছিল। তার মধ্যে ভারতের বিমান হামলার উদ্দেশ্য জাতীয় নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কিছুও যে হতে পারে—এমন কথা তারা বলতে পারছে না।
তবে বাস্তবতা হলো, বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি লোকসভা নির্বাচনের ৫০ দিনের কম সময় আগে তাঁদের রাজনৈতিক নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। আসন্ন চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক পরিবেশে মোদির এই স্ক্রিপ্টে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি প্রধান উপাদান থাকবে। এক. তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নেতা, যাঁর ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারে। দুই. একটি ‘জাতীয়তাবাদী’ দল, যারা ভারতীয় স্বার্থ সবার আগে দেখে। তিন. ‘অধিকতর’ শক্তিশালী এমন এক ভারত, যে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করতে সামরিক নীতিই বদলে ফেলেছে।
এটা ঠিক যে পুলওয়ামা হামলা কিংবা তার জবাবে ভারতের বিমান হামলার কোনোটিকেই রাজনীতিকীকরণ করা উচিত হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর অনেক দেশে এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ও সামরিক অভিযানকে নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হয়।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া জটিল। সাধারণত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফলের একটি সামগ্রিক রূপ এই নির্বাচনে দেখা যায়। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য আছে। আঞ্চলিক দলগুলো বিধানসভা নির্বাচনে সব সময়ই বড় ভূমিকা রাখে। স্থানীয় প্রার্থীর ব্যক্তিগত নেতৃত্বের গুণ, জাত–পাত, সামাজিক অবস্থা, জোটের হিসাব, ধর্মীয় মেরুকরণ—এসব স্থানীয় বিষয় ভোটের হিসাবনিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইভাবে জনমানসের অর্থনৈতিক অবস্থা–সম্পর্কিত ধারণাও নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। নির্বাচনী প্রচারের ধরনও ভোটের ফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। একটি মাত্র বিষয়ের ওপর কোনো দলের হারজিত নির্ধারিত হয় না।
ভোটের কথা মাথায় রেখে বিজেপি পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হামলা ও তার জবাবে ভারতীয় বিমানের অভিযান নিয়ে গর্বভরে কথা বলবে। জবাবে কী বলা যায় তা ঠিক করতে বিরোধী দলগুলোকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। গত বছর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে ২০১৪ সালের তুলনায় বিজেপির জনপ্রিয়তা সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। ওই নির্বাচনে ‘মোদি হাওয়া’ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে। এর মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের পালে আবার হাওয়া বইতে শুরু করে। রাহুল গান্ধী উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যপটে হাজির হন, তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রও রাজনীতিতে চলে আসেন। বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে প্রধান বিরোধী দলগুলোর মধ্যে জোরালো জোট হয়েছে। ভারতে গত কয়েক বছরে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, অর্থনৈতিক মন্দায় প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজেপির রাজ্য সরকারগুলোর কার্যক্রমও ভালো ছিল না। উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতে বিজেপির অবস্থা এখন খুবই খারাপ।
এ অবস্থায় বিজেপির শীর্ষ নেতারা দুটি বিষয় জনগণের সামনে তুলে ধরতে চাইছেন। ১. বিজেপি জনগণকে এই বার্তা দিতে চাচ্ছে যে মোদির বিকল্প নেতা এ মুহূর্তে ভারতে নেই। তিনি যেকোনো জাতীয় সংকট সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন। ২. বিজেপি দেখাতে চায় আবাসন, শৌচাগার, রাস্তাঘাট, বিদ্যুতায়ন—এসব খাতের উন্নয়নে তারা কতটা ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন নেতা গত মাসে খুব সরলভাবে বলেছেন, ‘মোদি সব সময় বিশ্বাস করেন নির্বাচনে অবশ্যই জনগণের আবেগ কাজে লাগাতে হবে। সেই রকমের জোরালো আবেগের অভাব রয়েছে।’
এই বিমান হামলা বিজেপিকে সেই ‘জোরালো আবেগের’ জোগান দিয়েছে। ১০ দিন ধরে নানা মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে স্বতঃস্ফূর্ত জনক্ষোভ ও সংগঠিত প্রচারকে কাজে লাগানো হয়েছে। একটি সভায় স্বয়ং মোদি বলেছেন, পুলওয়ামার ঘটনায় ভারত পাকিস্তানের ওপর কতখানি ক্ষুব্ধ, সন্ত্রাসীরা ভারতীয় জওয়ানদের হত্যা করে কত বড় ভুল করেছে, নিরাপত্তা বাহিনীকে তিনি সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য কতখানি স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং এর কড়া জবাব হিসেবে কত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিজেপির নেতারা পুলওয়ামা হামলায় নিহত ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির হয়েছেন এবং তাঁদের স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। মোদিকে খুব দৃঢ়চেতা নেতা প্রমাণ করার জন্য এখন এই বিমান হামলার প্রচার চালানোর জন্য আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে যা যা করা দরকার, বিজেপি তা করবে। বিজেপি বলতে থাকবে মুম্বাই হামলার সময় কংগ্রেস চুপ থেকেছিল কিন্তু উরি ও পুলওয়ামা হামলার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে। বলতে থাকবে, ভারত এ মুহূর্তে হুমকিতে রয়েছে এবং সেই হুমকি মোকাবিলা করার মতো শক্ত নেতা নরেন্দ্র মোদি।
এই প্রচারণা কাজে আসবে কি না, তা শুধু ভোটের ফলাফলেই জানা যাবে। তবে বিজেপির এই প্রচার শেষ পর্যন্ত কাজে আসুক বা না আসুক, এতে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো যে বেকায়দায় পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। তারা ভালো করে জানে, পুলওয়ামা হামলার পর জনগণ ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তারা এর জবাব দিতে বলেছে। বিজেপির পক্ষ থেকে বিমানবাহিনীর অভিযানের প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু অ-বিজেপি নেতারা সংকটে পড়েছেন। তাঁরা না পারছেন সরকারকে অভিবাদন জানাতে, না পারছেন সমালোচনা করতে। অভিযানকে অভিনন্দন জানালে তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে মোদির কৃতিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হবে। আর সমালোচনা করলে বিজেপি অভিযোগ করে বলবে, জাতীয় সংকটের মুহূর্তেও বিরোধীরা নোংরা রাজনীতি করছে।
এই বিমান হামলা ভারতের সামগ্রিক নির্বাচনী ফল হয়তো বদলে দেবে, হয়তো দেবে না। কিন্তু এই অভিযানগুলো রাজনৈতিক ভাষ্যের ধরনে পরিবর্তন আনবে, এমনকি নির্বাচনী প্রচারের বক্তৃতা–বিবৃতিতেও পরিবর্তন আনবে। সেটা বিজেপির পক্ষেই যাবে। বিজেপির এই চাল প্রতিহত করতে হলে বিরোধী দলগুলোকে সৃজনশীল কোনো উপায় দ্রুত বের করতে হবে।
হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
প্রশান্ত ঝা হিন্দুস্তান টাইমস–এর সহযোগী সম্পাদক