বিজেপির নির্বাচনী বাজিতে 'কাশ্মীর যুদ্ধের' তাস
রাজনীতির যেখানে শেষ যুদ্ধের সেখানেই শুরু
যুদ্ধ বরাবরই রাজনৈতিক ঘটনা। তবে রাজনীতি যখন আর কোথাও পথ পায় না, তখনই যুদ্ধবিদ্যার খোঁজ পড়ে।
ভারতে জাতীয় নির্বাচনের সময়গণনা শুরু হবে আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে। আগামী ৫০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন। প্রচারণাও শুরু হয়ে গেছে। প্রচারমাধ্যমগুলো এত দিন বলছিল, এটা হবে ‘সকল যুদ্ধের জননী’ (মাদার অব অল ব্যাটল)। কিন্তু কোনোভাবেই বিজেপি ‘যুদ্ধ’ শেষে পুনরায় ক্ষমতায় আসার অঙ্ক মেলাতে পারছিল না। ঠিক এ সময়ই ঘটল কাশ্মীরে আধা সামরিক বাহিনীর ৪৪ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের মতো দুঃখজনক ঘটনা। আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে এই হামলার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সে বিষয়ে খোদ ভারতেই তর্ক হচ্ছে কিন্তু কেউই অস্বীকার করছে না, এই ঘটনার বিপুল প্রভাব পড়বে নির্বাচনী পাটিগণিতে। ইতিমধ্যে ভারতজুড়ে উত্তেজক জাতীয়তাবাদী আবেগের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, যা বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে বেশ খাপ খায়। তৃণমূল কংগ্রেসের একজন বিধায়ক (এমএলএ) অবশ্য এ ঘটনার জন্য মোদি সরকারকেই দায়ী করেছেন।
নির্বাচনী প্রশ্নটা যেভাবে ঘুরে গেল
সুশাসনের ঘাটতি আছে—এমন দেশে সাধারণ মানুষ কেবল ভোটের দিনই ক্ষমতাচর্চার সুযোগ পায়। ফলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এসব দেশে ক্ষমতাসীনদের পুনর্নির্বাচিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতে এযাবৎকালের জাতীয় নির্বাচনে দুই–তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছে। তারপরও পুনর্নির্বাচনের লক্ষ্যে গত ১২ জানুয়ারি বিজেপি তার নির্বাচনী প্রচার শুরু করে আনুষ্ঠানিকভাবে।
কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বিজেপির আসন কমার সম্ভাবনাই দেখছিলেন এত দিন। ভারতে ক্রমেই আঞ্চলিক দলগুলোর শক্তি-সামর্থ্য বাড়ছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহুমুখী হওয়া মাত্রই ৫ শতাংশ ভোটারের পক্ষ পরিবর্তনে বহু আসনের হেরফের হয়ে যায়। গত কয়েক মাসে ভারতজুড়ে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কেন্দ্রীয় প্রশ্নই ছিল—‘মোদির আসন ঠিক কতটা কমবে?’ এখন প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে—কাশ্মীর অধ্যায় থেকে মোদি ও বিজেপি কতটা সুফল পাবে?
নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৯: মোদি যে কারণে উদ্বিগ্ন
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একা পায় ২৮২ আসন। জোটগতভাবে তার পক্ষে ছিল ৩৩৬ আসন। সরকার গঠন করতে লোকসভায় দরকার ২৭৩টি আসন। এর অর্থ হলো দলগতভাবে গতবারের চেয়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি আসন এবং জোটগতভাবে ৬০ থেকে ৭০টি আসন কম পেলেই বিজেপির ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হবে। বিজেপি দলগতভাবে যদি ১০ শতাংশ আসন (২৮টি) হারায়, তাহলে তার আসন দাঁড়াবে ২৫৪টি এবং জোটগতভাবে হবে ৩০২টি। তখন মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কেবল জোটগতভাবে। কেবল জোট চাইলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। আর ২০ ভাগ আসন (৫৬টি) হারালে সেই সম্ভাবনাও থাকে না। ফলে, কাশ্মীর হামলার আগে বিজেপির জন্য উদ্বেগ ছিল দুটি। গতবারের অনেক মিত্র তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল এবং দলটির নিজেরও জনপ্রিয়তা কমছিল।
বিজেপির আসন কমার শঙ্কা শুরু হয় গত ডিসেম্বরে হিন্দিপ্রধান রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয় থেকে। এই তিন রাজ্য মিলে লোকসভায় আসন ৬৫টি। বিজেপি গত লোকসভায় এর ৬২টিই পেয়েছিল। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের ফল দেখে মনে হচ্ছিল, এই তিন রাজ্যে বিজেপি অন্তত ৩০টি আসন হারাবে। আসনের দিক থেকে ভারতের প্রধান রাজ্য উত্তর প্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে গত নির্বাচনে তারা পায় ৭২টি। এবার প্রতিপক্ষ মায়াবতী ও অখিলেশের যাদবের জোট হওয়ায় সেখানেও নিশ্চিতভাবে বিজেপির আসন কমবে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ মহারাষ্ট্রেও বিজেপি সাবেক মিত্র শিবসেনাকে সঙ্গে পাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই রাজ্যে লোকসভা আসন ৪৮টি। গতবার বিজেপি-শিবসেনা জোট পায় ৪১টি। মহারাষ্ট্রের মতোই অন্ধ্রপ্রদেশেও বিজেপিকে ছেড়ে গেছে তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। গত লোকসভায় টিডিপি-বিজেপি জোটের ছিল রাজ্যের ৪২ আসনের মধ্যে (১৬+৩) ১৯টি।
ভারতে রাজ্যের সংখ্যা ২৯। এর মধ্যে ওপরের ছয়টি রাজ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। লোকসভার অর্ধেকের বেশি আসন রয়েছে এগুলোয়। কিন্তু কোনোভাবেই এসব রাজ্যে বিজেপির আসন বৃদ্ধির সুযোগ নেই। সর্বত্র আসন কমারই শঙ্কা ছিল। উপরিউক্ত ছয় রাজ্যের ২৩৫টি আসনে যদি বিজেপি ১০ শতাংশও হারায়, তাহলেও প্রায় ২০টি আসন কমার কথা, যা স্পষ্টভাবে বাকি রাজ্যগুলো ছাড়াই লোকসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ক্ষুণ্ন করে।
এই চিত্রের মধ্যে কেবল মহারাষ্ট্রে বিজেপি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারে যদি শিবসেনাকে পায় এবং অন্ধ্রে আসন ধরে রাখতে পারে যদি স্থানীয় ইএসআর কংগ্রেসকে নতুন মিত্র বানাতে পারে। তারপরও সমস্যা রয়েছে। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ও শারদ পাওয়ারের ন্যাশনাল কংগ্রেস ইতিমধ্যে জোটবদ্ধ হয়েছে এবং অন্ধ্রে ইএসআর কংগ্রেসের সমর্থক ভিত্তি হলো মূলত খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা, যারা বিজেপিকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। ওপরের ছয় রাজ্যে বিজেপিকে ২০১৪ সালের ফল ধরে রাখতে হলে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা প্রয়োজন। আবার এসব রাজ্যে কিছু আসন হারালে সে ক্ষতি পূরণ করা যেত পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও বিহারে। সেখানেও উত্তেজক কোনো রাজনীতি ছাড়া হিন্দুত্ববাদের পরিসর বাড়ানো যাচ্ছিল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কমিউনিস্টদের শক্ত প্রতিরোধের কারণে। এই তিন রাজ্যে রামমন্দির ইস্যুতে বিজেপির নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই। কাশ্মীরে আধা সামরিক বাহিনীর (সিআরপিএফ) নিহত সদস্যদের রক্তের আবেগ হয়তো এ ক্ষেত্রে বিজেপিকে সাহায্য করতে পারে।
যে কারণে মোদির উন্নয়ন মডেল ভোট টানতে ব্যর্থ
২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণার মূল চমক ছিল উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি ও দুর্নীতিবিরোধিতা। কর্মসংস্থানে মোদি অনেকখানি অসফল। জিডিপি বাড়লেও তার কোনো প্রভাব নেই চাকরির বাজারে। সর্বশেষ হিসাবে ১৬ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত বেকার।
আরেক সমস্যা মজুরির নিম্নহার। শ্রমজীবীদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিন্তু ৮২ ভাগ পুরুষ এবং ৯২ ভাগ নারী শ্রমিকের মজুরি এখনো ১০ হাজার রুপির নিচে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করলে ‘প্রকৃত মজুরি’ যা দাঁড়ায়, তাতে মানসম্মত জীবনযাপন দুরূহ। গত এক বছর নয়াদিল্লিমুখী কৃষকদের পুনঃপুন লংমার্চ জানিয়ে দিচ্ছিল গ্রামীণ অর্থনীতিও ভালো নেই। ফলে, ‘মোদি মডেল’-এর পাঁচ বছর আগের উচ্ছ্বাস অনেকখানি মিলিয়ে গেছে। দুর্নীতির অভিযোগও তাড়া করছে প্রধানমন্ত্রীকে। ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলগুলো।
তবে এসবই মোদির আসন কমানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না, যদি তাঁর দলের বিরুদ্ধে প্রতি আসনে দুই থেকে তিনটি করে দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামত। প্রতিটি লোকসভা আসনে বিরোধী শিবির বিজেপিকে প্রতিপক্ষ ভেবে জোটবদ্ধ হলেই কেবল দলটির জন্য দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। সেটাই ঘটছিল সর্বশেষ। কংগ্রেস ও অন্য প্রায় সব বিরোধী দল নানানভাবে জোটবদ্ধ হয়ে চলছিল। উত্তর প্রদেশে মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপির জন্য বড় হুমকি তৈরি করে। অন্ধ্রে টিডিপি ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কংগ্রেস কতটা আশাবাদ তৈরি করতে পারছে
পুরোনো দল হিসেবে কংগ্রেস ভারতীয়দের খুব চেনা। এই দল চমক সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না। গরিবমুখী কিছু কর্মসূচি এবং প্রিয়াংকা গান্ধী ভদ্রকে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটানো ছাড়া কংগ্রেসের হাতে আর কোনো অস্ত্র নেই। ভারতের রাজনীতির মাঠ সম্ভবত এমন কাঁচা নেই যে হঠাৎ আবির্ভূত প্রিয়াংকা বাজিমাত করার ক্ষমতা রাখেন। শেষ বিচারে কংগ্রেসকে রাহুলের ওপরই ভরসা করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বে উত্তর ভারতে কংগ্রেস বিধানসভার নির্বাচনগুলোয় ভালো করেছে। লোকসভার নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটবে কি না, সেটা দেখার বিষয়। তবে নিশ্চিতভাবেই কিছু ভালো করবে তারা। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে তারা গত বছর মাত্র তিনটি লোকসভা আসনে জেতে। এবার সংখ্যা ৩০ হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর হত্যাকাণ্ডকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মোদি সরকার যদি পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষে জড়ায়, তাহলে কংগ্রেসকেও জাতীয়তাবাদী হুংকারের রাজনীতিতে নামতে হবে। এতে মোদি জমানার দুর্নীতি ও বেকারির প্রচারণা ধামাচাপা পড়তে বাধ্য। বিজেপি ঠিক সেটাই চাইছে।
পুলওয়ামার রক্তক্ষুধা বিজেপির ফ্রাংকেনস্টাইন হতে পারে
২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদিঢেউ ছিল বিজেপির প্রধান অস্ত্র। এবার মোদির আবেদন আগের মতো নেই। এর অর্থই হলো ফলাফল নির্ধারণে স্থানীয় রাজনীতির আধিপত্য। কিন্তু কাশ্মীর অধ্যায়ের পর রাজ্যভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া জগৎগুলো এ মুহূর্তে পুরোপুরি ‘জাতীয়’ চরিত্র নিয়ে কল্পিত প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে লড়ছে। ফলে, ছোট দলগুলোর স্থানীয় ইস্যুভিত্তিক এত দিনের সংগ্রাম এবং বিজেপির এত দিনকার উগ্রবাদিতার বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীদের আপত্তিগুলো আড়ালে পড়ে গেল। কৃষি ও অর্থ ব্যবস্থার সংকট নিয়েও সংবাদপত্রে হয়তো দীর্ঘদিন আর শিরোনাম দেখা যাবে না। মোদি খানিকটা অক্সিজেন পেলেন এভাবে।
তা ছাড়া বিরোধী শিবির যদিও বিজেপিকে রুখতে একাত্ম, কিন্তু তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কে হবেন, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা আছে। এমন কোনো আঞ্চলিক নেতা নেই, যাঁর নিজ রাজ্যের বাইরে দ্বিতীয় কোনো রাজ্যে বড় অঙ্কে আসন পাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। বিরোধী শিবিরের এই চেহারা বিজেপির বড় ভরসার দিক। সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। ‘জাতীয়তাবাদী গর্ব’ও তাদের জন্য জরুরি। তাই কাশ্মীরকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে মোদি ও অমিত শাহ জুটি আবারও পাঁচ বছরের জন্য মসনদ দখলে রাখার স্বপ্ন দেখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি একটাই। কাশ্মীরের পুলওয়ামার ঘটনায় ভারতজুড়ে যে জাতীয়তাবাদী রক্তক্ষুধা তৈরি হয়েছে, তাকে যদি মোদি প্রশাসন যথেষ্ট খাবার দিতে না পারে, সেটা হবে বিজেপির জন্য বিপর্যয়কর। জাতীয়তাবাদ ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবের মতো। তা তার স্রষ্টাকেও খেয়ে ফেলতে পারে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক