ঘাটাইলের আজিজ মুনশিকে আমি চিনি না, আপনাদের অধিকাংশও চেনেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি বিখ্যাত হতে চাননি, তাঁর নাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই খবর তিনি পেয়েছেন কি না, জানি না। সম্ভবত পাননি। রাজধানী ঢাকায় তিনি আগে এসেছিলেন কি না, তা নিয়েও আমার মনে সংশয় আছে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁকে আসতে হয়েছে। সেই সূত্রে আমি-আপনি তাঁর নাম জানতে পেরেছি। আমরা জানতে পেরেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়ার নাম। জানতে পেরেছি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচল মানুষ, কানেও শোনেন না এমন একজন শামসুল হকের কথা। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কোনো গ্রামে। আপনাদের মতো আমিও এখন স্বস্তি বোধ করছি যে সুনামগঞ্জের অধিবাসী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তারা মিয়ার শেষ পর্যন্ত জামিন হয়েছে, ছয় সপ্তাহের জামিন। আতর বিক্রেতা ‘হাতকাটা’ ইউসুফের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সেই খবর আমি জানি না। ১১টি মামলার আসামি মোহাম্মদপুরের ‘হাতকাটা’ ইউসুফের জামিনের ব্যবস্থা কে করবেন, তাঁর পরিবার তা পেরেছে কি না, সে খবর আমি কোথাও খুঁজে পাইনি, সম্ভবত ওই পরিবার আর তাঁর নিকটজনেরা ছাড়া আর কেউ জানার প্রয়োজন বোধ করছেন না।
এই যে এসব মানুষের কথা বললাম, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী, ৩০ ডিসেম্বরের ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, সংসদে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আসন নিয়েছেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ। আইনের ভাষায় যদি বলি তাহলে তাঁদের সরকারের প্রতিপক্ষ না বলে অন্য কিছু বলার উপায় নেই। কেননা, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো যেনতেন মামলা নয়। তাঁরা নাগরিকের ভোট দেওয়ার কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছেন, সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থেকেছেন। ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব কথা আছে পুলিশের করা মামলায়। সংবাদপত্রের ভাষায় এগুলো হচ্ছে ‘গায়েবি’ মামলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘গায়েবি মামলা বলতে কোনো কিছু আমাদের অভিধানে নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তাহলে কি আমাদের এমন অদ্ভুত অভিযোগ সত্য বলে মনে করতে হবে যে, ডান হাত অস্বাভাবিক চিকন, কোনো চেতনা নেই, বাঁ হাতেও সমস্যা, কোনো কাজ করতে পারেন না, সেই তারা মিয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী? মানতে হবে যে তিনি রামদা, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছেন—এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য?
মামলাগুলো ‘গায়েবি’; কিন্তু মানুষগুলো বাস্তবের, রক্ত–মাংসের মানুষ। তাঁদের অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কেউ কেউ চলতে পারেন না, চাষাবাদের কাজে যাঁদের দিন কাটে, যাঁরা জানেন না তাঁদের অপরাধ কী। কিন্তু এখন তাঁদের আসতে হয়েছে এবং হচ্ছে রাজধানীর হাইকোর্টে। তাঁদের চাওয়া একটাই, ‘জামিন’। এমন মানুষের সংখ্যা কত? গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি ‘গায়েবি’ মামলা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। এসব মামলায় ৮৮ হাজার জনের নাম উল্লেখ আছে। আর আসামি করা হয়েছে পৌনে তিন লাখ ব্যক্তিকে। এই হিসাব তো নভেম্বরের আগের, তারপর নির্বাচন হয়েছে।
সরকার, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন একটি ‘আন্তর্জাতিক মানের’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছে। বারবার বলা হচ্ছে যে এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দেখে বলাই যায় শান্তিপূর্ণই ছিল নির্বাচন। কিন্তু তা–ই যদি হবে, তবে এই যে লাখ লাখ মানুষ অভিযুক্ত, এই যে হাজারে হাজারে মানুষ আদালতের দরজায় মাথা কুটে মরছেন, তাঁরা কারা? তাঁদের অপরাধ কী? অন্য যেকোনো সময়ে আমরা বলতে পারতাম যে এই সব মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা ভুলে যাবেন না, ভবিষ্যতে তাঁরা এর রায় দেবেন। এখন যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানে এই সব ক্ষোভ–বিক্ষোভের তোয়াক্কা করার দরকার নেই।
হাইকোর্টের বাইরে যেমন জামিনপ্রত্যাশীদের ভিড়, তেমনি কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজনের ভিড়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আটক হয়েছেন ‘রাজনৈতিক’ কারণে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে জানতে পারি এক জননীর কথা; হেনা, সন্তানের নাম হাবিব। ‘(হাবিব) নভেম্বর মাসে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে আসছিল। মুড়ি কিনতে বাসা থেকে বের হলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খুঁজে পাইনি।’ হেনা জানান, নির্বাচনের আগে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে ঘটে যাওয়া পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় হাবিবকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হাবিব জামালপুরেই থাকেন। তাঁর মা হেনা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। বাড়িতে থাকে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসছিল। পুলিশ শুধু শুধু মামলা দিয়েছে।’ তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পর তিন মাস ধরে কেরানীগঞ্জ কারাগারেই আছেন হাবিব, (মানবজমিন, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯)।
পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায় আবিদ উল্লাহর কথা। আবিদ উল্লাহ বলেন, ‘আমার ভাইকে মামলা দেওয়ার বয়সই হয়নি। সে এখনো অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ছোট ভাইয়ের জামিন নিয়েও প্রতিদিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন কত নেতার কাছে ঘুরি। কোনো কাজ হয় না। একটা অবুঝ ছেলে, সে মামলার কী বোঝে। উকিল ধরছি, এখনো জামিন কবে পাইব জানি না।’ কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ আটক আছেন। এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে নির্বাচনের অব্যবহিত আগের মাসগুলোতে। গত কয়েক বছরে আটক বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কথা তো আমরা প্রায় বিস্মৃতই হয়েছি। মানুষ গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৮ সাল থেকে আমরা গায়েবি মামলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।
এসব গায়েবি মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই এসব জামিনের ব্যবস্থা করতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলো তো বাতিল হচ্ছে না। সেগুলোর হাজিরা চলবে ভবিষ্যতে। কত দিন? কেউ জানে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা অব্যাহত আছে, নিয়মিতভাবেই তাঁদের হাজিরা দিতে হয় বলেই জানি। শুধু তা–ই নয়, সম্প্রতি পোশাকশ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলে আটক করা হয়েছে অনেককে, তাঁদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার উপায় কোথায়? এ নিয়ে কথা বললেই ষড়যন্ত্রের গল্প শোনানো হবে। শুধু তা–ই নয়, ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই সব দেখে সবকিছুকেই ‘গায়েবি’ বলেই মনে হয়।
এই যে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য একটাই—সবাইকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া যে তাঁদের কী পরিণতি হতে পারে। রাজনীতি না করলেও এই যদি অবস্থা হয়, তবে রাজনীতি করলে কী হবে, সেটা অনুমানের ব্যবস্থা করা। সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা। এর একটা শ্রেণিবিভাজনও আছে। শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন না, কেননা তাঁদের পরিচিত কাউকে তো এমন অবস্থায় পড়তে দেখছেন না। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাড়ল কি না, তাঁদের চাকরি থাকল কি না, ঘাটাইলের আজিজ মুনশির কী হলো, তা নিয়ে বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্তের উদ্বেগের কিছু নেই। কেননা, শ্রেণিগতভাবে এটা তাঁদের জানাই আছে যে প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ তাঁদের পাতেই আসবে। তাঁদের সম্ভবত করার আরও অনেক কিছুই আছে। সংবাদপত্রের পাতায় এসব খবর বড়জোর কতগুলো সংখ্যামাত্র।
রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীনেরা যে এই মানুষদের কথা ভাবছে না, তা দরিদ্র, সাধারণ মানুষ জানে। আদালতের কাছে ‘জামিনের’ জন্য এসেছেন, আসছেন, আসবেন—কিন্তু সেখানে বিচার পাবেন, এমন আশা তাঁদের নেই। সে কারণে আজিজ মুনশি বলেছেন, ‘দোয়ার দরখাস্ত রাখলাম। এক বিন্দু অপরাধ করি নাই। ওপরের উনি সব দেখছেন।’ (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯)।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
আরও পড়ুন
‘ওপরের উনি সব দেখছেন’