নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে চালের আমদানি শুল্কের বর্ধিত হার কার্যকর হওয়ার আগেই দেশের চাল ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধভাবে পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে অন্যায় করেছেন। কিন্তু এ অন্যায়ের প্রতিকারে সরকারের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন জাগছে, জনগণের প্রধান ও প্রাথমিক খাদ্যের বাজারের দিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর আদৌ কোনো দৃষ্টি আছে কি না।
গত বছর দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। চালের দাম বেড়ে সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। এর প্রধান কারণ ছিল বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা ও মহলবিশেষের দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতাও ছিল চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
এ বছর চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ এখনো ঘটেনি। চালের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ কার্যকর হওয়ার পরও দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকবে না। কারণ প্রথমত, দেশে এখন চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে, সরকারি গুদামগুলোতে বর্তমান মজুতের পরিমাণ ১০ লাখ টন। দ্বিতীয়ত, এবার ১ কোটি ৯২ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে। তৃতীয়ত, ইতিমধ্যে ৩৮ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে এবং আরও ৪৫ লাখ টন আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষত যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে চাল আমদানি করা হয়, সেসব দেশে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। ভারতে টনপ্রতি ৬ থেকে ৮ ডলার ইতিমধ্যে কমে গেছে; থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এক মাস ধরে চালের দাম বাড়ছিল, কিন্তু এখন বাড়া বন্ধ হয়েছে এবং অচিরেই কমতে শুরু করবে বলে বলা হচ্ছে।
দেশের ভেতরে পর্যাপ্ত উৎপাদন হলে, সরকারি গুদামে চালের মজুত যথেষ্ট থাকলে এবং বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে এই ঘটনা ঘটছে; পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে গেছে। এটা চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের সংঘবদ্ধ কারসাজি। বিশেষজ্ঞ ও বাজার পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, চালের বাজারে সরকারের কার্যকর নজরদারি থাকলে এমনটা ঘটতে পারে না।
১০ জুন প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, বাজেটে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ পুনর্বহাল করার দুই দিনের মধ্যেই চালের বাজারে কারসাজি শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে তিন টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা অন্যায়, কারণ খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ীদের চাল যদি আমদানি করা হয়ে থাকে, তবে সেগুলো আমদানি করা হয়েছে চালের নতুন আমদানি শুল্ক ঘোষণা করার আগে। এসব চাল আমদানি করা হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে। চাল ব্যবসায়ীদের এমন অন্যায় কারসাজি সংবাদমাধ্যম সরকারের দৃষ্টিগোচর করার পরও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি, ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে যে হারে চালের দাম বাড়িয়েছেন, সেই হারে তা কমানোর জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি।
চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা সরকারের একান্ত দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। চালের বাজার নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা, অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের গতি–প্রকৃতির দিকে নিয়মিত নজর রাখা একান্ত জরুরি। চাল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মহলবিশেষের কায়েমি স্বার্থতাড়িত অপতৎরতাও স্থায়ী ও নিয়মিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এসব স্থায়ীভাবে দূর করে চালের বাজারে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।