ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য সহায়ক যেসব সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্য রয়েছে, সেসবের মধ্যে বেশ কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। এর অন্যতম সর্বত্র উচ্চগতির ইন্টারনেট। থ্রি–জি ও ফোর–জি শহরের জন্য যতটা জরুরি, গ্রামের জন্য ততটা নয়। রোজগারের জন্য গ্রামে যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁরা আলাদাভাবে শুধু মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, যেটুকু করেন সেটা সীমিত ক্ষেত্রে। বিশেষত তরুণসমাজের জন্য আয়মুখী কাজের সুযোগ তৈরি করতে গ্রামাঞ্চলে সম্মিলিত ব্যবস্থায় ব্রডব্যান্ড বা উচ্চগতির ইন্টারনেট সম্প্রসারণ দরকার। ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০০০ ইউনিয়নে গ্রাহক পর্যায়ে লিজ লাইন দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
বিটিসিএলের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি এমবিপিএস গতির মূল্য ধরা হয়েছে নানা পর্যায়ে ৩২৪ থেকে ৯৬০ টাকার মধ্যে। সরকারি-বেসরকারি খাত যেভাবেই হোক, যদি এই ইন্টারনেটের নিরবচ্ছিন্ন গতি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নানা রকম প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানচর্চার ফলে গত এক দশকে গ্রামে গ্রামে আইটি খাতে আয়মুখী নতুন ও উদ্ভাবনী কাজের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেসবের একটি বাস্তব প্রতিফলন আমরা আগামী পাঁচ বছরেই দেখতে পাব। এর জন্য গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন দরকার। বিটিসিএল এসব কাজে এখনো অনেক পুরোনো নিয়ম চালু করে রেখেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের আয়োজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেমন করে গ্রামে কাজের সুযোগ হবে—এ নিয়ে অনেকে বিতর্ক করেন এবং কূলকিনারা খুঁজে পান না। দায়ী করেন কম শিক্ষা, ইংরেজি না জানা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে। আমরা যদি সহজ করে ভেবে দেখি, অন্তত দু–একটি খাতে সীমাবদ্ধ না রেখে, যেমন শিক্ষা (যে খাতে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে অনেক কাজ হয়েছে), স্বাস্থ্য (সেবা উন্নয়নে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে) ছাড়াও সব উন্নয়ন খাতের পরিকল্পনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে আর যাই-ই হোক, প্রতিটি গ্রামে একটি করে ‘তথ্যভান্ডার’ গড়ে তোলা হয়, তাহলে সরকারের সবগুলো উন্নয়ন সূচক এক লহমায় হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর এই কাজে যুক্ত হতে পারে গ্রামের যুবসমাজ, যারা এসএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগ এই কাজের উদ্যোগ নিতে পারে একই সঙ্গে সারা দেশের জন্য। প্রতি গ্রামের জন্য যদি গড়ে চারজন কর্মী (নারী-পুরুষ সমান অনুপাতে) নিয়োজিত করা হয়, তাহলেও ৩ থেকে ৪ লাখ যুবশক্তির কর্মসংস্থান হয়। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এখন এক মানবিক ভাবাদর্শের আলোকে উজ্জ্বল, সেখানে আর ভুল পদক্ষেপের সুযোগ নেই। সমাজের সব মানুষকে এখন কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ওই মানবিক বাংলাদেশ দর্শন বাস্তবায়নের জন্যই।
সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) মতে মোট ২৪টি খাতের সূচকে উন্নয়ন ঘটলে আমাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ হিসাবে ধরে ঠিকভাবে এগোলে আমাদের গড় অর্জন হবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তার জন্য যে ২৪টি উন্নয়ন সূচকের চিন্তা করা হয়েছে সেগুলো হলো শিল্প, সেবা, কৃষিসহ দারিদ্র্যের হার, অতিদারিদ্র্যের হার, জনসংখ্যা, মূল্যস্ফীতি, জাতীয় সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রপ্তানি, শিশুমৃত্যুর হার, বিদ্যুৎ
উৎপাদন, বিদ্যুৎ সেবার আওতা বাড়ানো, বনাঞ্চল বৃদ্ধি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, নতুন রেলপথ নির্মাণ, প্রবাসী আয়, গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি ব্যয়, পদ্মা সেতু ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ, শহর ও গ্রামগুলোকে শতভাগ স্যানিটারি ল্যাট্রিনের আওতায় আনা, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি বা আইসিটির ব্যবহার।
বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনার মূলে রয়েছে গ্রাম ও গ্রামের মানুষ। এখন সময় হয়েছে এই সমাজের সব তথ্য হাতের কাছে রাখা, যার ফলে সম্ভব হবে যখন যেখানে যে কাজ করা দরকার, তার পরিকল্পনা বাস্তবমুখী রাখা ও সমাজের সব প্রান্তের মানুষকে এসব লক্ষ্য অর্জনে সম্পৃক্ত করা। এতে সহায়ক হবে ভিত্তিমূলের সব ধরনের উপাত্ত। নতুন সরকার যদি বছরের শুরুতেই এই তথ্যভান্ডার বিনির্মাণে হাত দেয়, তাহলে এসব ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হবে:
১। দেশের প্রতিটি গ্রামে গড়ে চারজন করে ‘স্মার্ট’ তথ্য সংগ্রাহক কর্মী তৈরি হবে, যাদের মোট সংখ্যা হবে আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ।
তারা সবাই হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রণী কর্মী। সরকারের প্রথম বছরেই এই কর্মসংস্থান সম্ভব শুধু সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পগুলো থেকে ‘কখন কার কী তথ্য প্রয়োজন হয় বা হবে’ সে রকম সম্মিলিত একটি পরিকল্পনা করে নিলে। এর জন্য আপাতত আলাদা করে অর্থ বরাদ্দের দরকার হবে না।
২। প্রত্যের তথ্য-সংগ্রাহক কর্মীর কাছে একটি করে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার সংবলিত মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ট্যাবলেট থাকবে, যার সাহায্যে ‘চাহিবামাত্র’ গ্রামের তথ্য নির্দিষ্ট সার্ভারে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এভাবে গ্রামে গ্রামে স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেটের প্রবেশ ঘটবে বা প্রযুক্তির অভিগম্যতা বাড়বে, যা প্রতিটি গ্রামকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত ও সমৃদ্ধ করবে। যেসব গ্রামে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড যেতে দেরি আছে, সেখানে ফোর–জি নিশ্চিত করে রাউটার দিয়ে উচ্চগতির ইন্টারনেটের সম্মিলিত ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এর জন্য আইটিইউ–নির্ধারিত ‘স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দেওয়া হচ্ছে কি না, তার তদারকি বাড়াতে হবে।
৩। তথ্য সংগ্রহ, তথ্য ব্যবস্থাপনা ও কর্মী ব্যবস্থাপনা—সবই হবে কেন্দ্রীয় স্মার্ট ব্যবস্থাপনার অধীনে। আমাদের দেশে অনেক টাকা দিয়ে ‘ডেটা সেন্টার’ করা হয়েছে, বেসরকারি কিছু ডেটা সেন্টারও তৈরি করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অভাবে ব্যান্ডউইডথ নিরাপত্তার সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশি ডেটা সেন্টার ব্যবসা যারা করে, তাদেরও আমরা আকৃষ্ট করতে পারছি না। স্মার্ট ব্যবস্থাপনা গড়ে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ‘বিগ ডেটা’ ব্যবস্থাপনার নজির তৈরি করতে পারি। এ ধরনের ডেটাবেইস উন্নয়ন গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার জন্যও জরুরি ও কার্যকর।
৪। এই ডেটা সংগ্রহ, বিন্যাস ও কেন্দ্রীয় সার্ভারে প্রেরণের জন্য গ্রামে গ্রামে উচ্চগতির ইন্টারনেটের অভিগম্যতা বাড়বে, যা একসময় শুধু এই একটি সরকারি সহায়ক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তখন নতুন নতুন বুদ্ধি এ দেশের তরুণদের আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ খুঁজতে ও পেতে সহায়ক হবে। পরিসংখ্যান হয়ে উঠবে জ্ঞানের ভান্ডার, যার বাজারমূল্য হতে পারে বছরে কয়েক মিলিয়ন ডলার। আমার ধারণা, তখন ‘ঘরে বসে কাজ ও আয়’ কথাটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে।
৫। গত এক দশকে ডিজিটাল বাংলাদেশের যেসব কাজ হয়েছে, তার বেশির ভাগই সরকারি উদ্ভাবনী কাজ; সেগুলো সেবা–সুবিধা শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে তথ্যভান্ডার তৈরি হলে তার ফলাফল ও সুবিধাগুলো গ্রাম থেকে শহরে যাবে। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে মুখ্য বিবেচনা ‘গ্রামের সমৃদ্ধি অর্জন’, তার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সফল পরিণতি ঘটবে। সেটা বাংলাদেশকে ২০৩০ সালেই পৌঁছে দেবে এসডিজি অর্জনের প্রধান কাতারের দেশগুলোর মধ্যে।
আমাদের সামনে এক মানবিক বাংলাদেশের আহ্বান। সে কাঠামোয় বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সুবর্ণ সময়ের উৎসবে দেখতে পাবে তার নিজেকেই। দেখবে মুক্তিযুদ্ধের পরে যে ধ্বংসস্তূপ থেকে সে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে আর বারবার হোঁচট খেয়েছে, এখন সে কোথায় এসে পৌঁছেছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে এখন স্কুল–কলেজে যায়, গ্রামে সবাই তাদের খবর জানে। কারণ, সব তথ্য এখন হাতে আছে। চাইলে ইন্টারনেটেও পাওয়া যায়। কারও বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব হলে, কোনো কৃষকের বাড়তি সামান্য কিছু বীজ বা পাড়ার দোকানির সামান্য কিছু বাড়তি পুঁজির দরকার হলে গ্রামের খবর কেউ অবশ্যই জানবে কোথায় গেলে সেসব সমস্যার সমাধান হবে। গ্রামগুলো হয়ে উঠবে শহরবাসীর অপেক্ষার জায়গা: কয়েক শ বছরের উল্টো পথ ঠিক হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, মানুষ আরও মানবিক হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তখন মানবিক বাংলাদেশ হবে।
রেজা সেলিম, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্পের পরিচালক
[email protected]