প্রবাসীদের 'দেশ' এবং বদলে দেওয়া বিজয়ফুল
অক্সফোর্ড থেকে পাঠানো আগের কিস্তির লেখাটা ‘হোয়েন ইজ ইওর ইলেকশন’ কারও কারও ভালো লাগেনি। প্রবাসে আমার ফ্রি ভাত-রুটি, গরম পানি আর লেপ-বালিশের কসম, তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। তাঁদের অনেকেরই দেশপ্রেমে যেমন আবেগ আছে, তেমনি আছে দেশের মুখ উজ্জ্বল করার আগ্রহ আর আন্তরিক চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, আমরা শুরু করি কিন্তু শেষ করি না, সে কথা প্রবাসী বন্ধুদের বেলায় খাটে না। শুধু একাত্তরেই তাঁরা সেটা করে দেখিয়েছেন তা নয়, দেশের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েনি কখনো। দেশকে সারা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরা এবং আগামী প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস জানিয়ে দেওয়ার দুটি মহৎ কাজের কথা এখানে বলা যাক।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
যেমন ৫২-তে রফিক-সালাম রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কানাডার ভাঙ্কুভার শহরের প্রবাসী দুই রফিক-সালাম (রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম বন্ধুদ্বয়) প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন আমাদের শহীদ দিবসকে (একুশে ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদ্যাপনের। তাঁরা দেশের সরকার বা রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের আশায় বসে না থেকে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোয় যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে ঠিক হয়, প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করবে জাতিসংঘ। ১৯৯৮ থেকে ২০১০—এক যুগ লেগে যায় তাদের কাজটা সম্পন্ন করতে। কেন এত সময় লাগল? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাষ্ট্রীয় গড়িমসি, কার আগে কার কথা বলব? রফিক-সালাম হাল ছাড়েননি। ফল আমরা পাচ্ছি।
বিজয়ফুল
একই বছর ১৯৯৮ সালে বিলাতে (যুক্তরাজ্যে) একেকটি উদ্যোগ আমাদের চমকিয়ে দিয়েছিল। প্রবাসী কবি শামীম আজাদ ও তাঁর বন্ধু-পরিচিতদের মধ্যে বিজয়ফুলের ধারণা দানা বাঁধতে থাকে। তাঁরা নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের বিজয়বার্তা পৌঁছানোর তাগিদ অনুভব করেন। শামীম আজাদ বিলেতে শিশুদের সঙ্গে কাজ করেন। তাদের গল্প শোনান। তাদের গল্পও শোনেন। সার্থকতার সঙ্গে তিনি এ কাজ করে চলেছেন। তাঁর আর তাঁর সঙ্গীদের মনে হলো একটা আনন্দময় কাজের অছিলায় নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট আর ইতিহাস গল্পের ছলে তুলে ধরতে পারলে তারা বিষয়টিতে মজা পাবে। শিশুমনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুদের পরিচিত পরিবেশ থেকে নেওয়া কোনো ফুল, পাখি, খেলনা, গাছ, রং ইত্যাদি নিয়ে খেলতে খেলতে তাদের কাছে বার্তা পৌঁছানো অনেক সহজ।
বিলেতের শিশুরা নভেম্বর মাসে সবার বুকে পপি ফুল দেখে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি নিজেদের গৌরবগাথা স্মরণ করে কাগজের বা কাপড়ের তৈরি লাল পপি দিয়ে। লাল পপি স্মরণিকা সূচিত হয় কানাডার এক চিকিৎসকের হাত ধরে। লে. কর্নেল জন মাক্রে একটা কবিতা লিখেছিলেন—‘ইন ফ্লানডারস ফিল্ড’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী এক ক্ষেত্র ছিল ফ্লানডারস ফিল্ড। সেখানে ফুটত পপি ফুল, যেন নিহত সৈনিকদের রক্তে ফোটা ফুল! লে. কর্নেল জন মাক্রের মর্মস্পর্শী সেই বর্ণনা জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিয়া মিচিলকে আলোড়িত করে। তিনি লেখেন আরেক অমর কবিতা—‘উই শ্যাল কিপ দ্য ফেইথ’। তিনি এই কবিতায় সবাইকে নভেম্বরে পোশাকের বুকের কাছে পপি ফুল ধারণের আহ্বান জানান। গোটা ইউরোপ সাড়া দেয় সেই ডাকে। পৃথিবীর অনেক জাতি ও দেশ ফুলের প্রতীক পোশাকে লাগায়।
লন্ডনের চিন্তাশীল প্রবাসী সমাজ ঠিক করে শিশুদের অভ্যস্ততাকে কাজে লাগিয়ে তারাও একটা ফুল দিয়ে তাদের বিজয় দিবস উদ্যাপন ও বিজয় দিবসের পাঠ দিতে পারে শিশুদের। তবে ফুলটা হতে হবে সহজে আঁকা যায়—এমন, আবার রংটা যেন আমাদের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের সঙ্গে মিলে যায়। আমাদের অনেক প্রিয় ফুল আছে, যার রং সাদা-সবুজে সীমিত, সাদা-সবুজ পাকিস্তানের জাতীয় রং। এসব চিন্তা থেকে শেষ পর্যন্ত জন্ম নেয় বিজয়ফুলের ঐতিহ্য। এই ফুল কোনো গাছে ধরে না, এই ফুল ফোটে হৃদয়ের মাঝে।
প্রচার শুরু করেন লন্ডনপ্রবাসীরা। কয়েক বছরে মধ্যেই যুক্তরাজ্য ছেড়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাজ্যের ৩৯টি স্থানে বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কর্মসূচি পালিত হয়। যুক্তরাজ্যের বাইরে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, বেলজিয়াম, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা এ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোররা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিজয়ফুল তৈরি ও বিতরণে কাজ করছে। সব মত আর পথ বিজয়ফুলকে ঘিরে এক হয়ে যায় বিলাতে, ইউরোপে, আমেরিকায়, মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ আছে সেখানে।
পাঁচটি সবুজ পাপড়ি আর মাঝখানে লাল বৃত্ত তৈরি করতে করতে শিশুরা জানতে চায়, কেন পাঁচটা পাপড়ি, কেন বৃত্তটি লাল? তখনই সুযোগ আসে স্বাধীনতার কথা বলার, দেশের কথা উচ্চারণের। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক সেলিম জাহান যেমন বলেছেন, ‘পাঁচটি পাপড়ি দিয়ে কত কিছু বোঝানো যায়! পাঁচটি মৌলিক অধিকার, আমাদের দেশের পাঁচটি প্রধান নদী, আমাদের সমাজের পাঁচটি গোষ্ঠী—মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। বিজয়ফুলের মাঝখানের লাল বৃত্তটি আমাদের স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক।’
ভাবতে অবাক লাগে, কত সযত্ন চিন্তাভাবনার পরে এমন সহজ একটি নকশা উদ্ভাবিত হয়েছে। দরকার শুধু পাঁচটি বৃত্ত চারদিকে আর তার মাঝখানে আরেকটি বৃত্ত। তারপর সবুজ রং করতে হবে চারদিকের পাঁচটি গোল্লাকে এবং লাল রং করতে হবে মাঝখানের বৃত্তটিকে। বিজয়ফুলের নকশা একটি বিমূর্ত ফুল, যা এটিকে অনন্য মাত্রিকতা দিয়েছে।
সাঁওতালদের পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামে, পাহাড়ধসে হারিয়ে যাওয়া চাকমা-মারমা জনপদে কিংবা উপকূলের জলদাসপাড়ায় অথবা ভাঙা চরের ক্ষুধার্ত জনপদে, যেখানই বিজয়ফুলের বার্তা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানেই এই ফুলের সহজ-স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ করেছেন সবাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা আবিষ্কার করেছেন চারুকলার অন্তর্নিহিত শক্তি—পাঁচ পাপড়ির মধ্যে মানুষকে আলিঙ্গন করার অপার ক্ষমতার পরিসর।
একসময় রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকর্তাদের নজরে আসে বিজয়ফুল। এবার সরকার ঠিক করেছে, তারা বিজয়ফুলের দায়িত্ব নেবে। ডিসেম্বরের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত বিজয়ফুল ধারণের কর্মসূচি পালন করবে। বিজয়ফুলের উদ্যোক্তা প্রবাসীরা এই প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করেছেন। তবে তাঁদের একটা কষ্টও আছে। বিজয়ফুল অধিগ্রহণের নথিপত্রের কোথাও প্রবাসীদের বিজয়ফুল প্রচেষ্টার স্বীকৃতি নেই। ফুলটাও পালটে ফেলা হয়েছে। লাল-সবুজের বদলে সাদা-সবুজের শাপলা হবে বিজয়ফুল। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল আবার সাত পাপড়ির শাপলা আমাদের জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের অন্য প্রয়োগ কতটা সুচিন্তাপ্রসূত আর কতটা তাড়াহুড়া করে করা, সেটা কে ভাববে এই ভোটের বাজারে?
গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক-গবেষক।