বেড়াতে গেছে আচরণবিধি
হাইকোর্টে দু-তিনজন নিয়মিত বই বিক্রেতা আছেন। প্রায় সপ্তাহে একবার আইনের নতুন বই নিয়ে আইনজীবীদের রুমে রুমে যান। ‘স্যার, বইটা গতকালই বেরিয়েছে। দাম ছয় শ টাকা, কিন্তু আপনার জন্য চার শ টাকা।’ দুই শ টাকা বাঁচানোর আনন্দে কিনে ফেলি। তাঁদের বদৌলতে আইনি বইয়ের খোঁজে দোকানে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। দু-চার শ টাকার বই হলে সহজেই কিনে ফেলি। আর দাম যদি হাঁকে দশ হাজার টাকা, তখন ঢোঁক গিলে আমতা-আমতা করে বলি, দুই সপ্তাহ পরে এসো। বলা তো যায় না, এই দুই সপ্তাহে বড় মক্কেল পেয়েও যেতে পারি।
নির্বাচন কমিশনের ছাপানো ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল’-এর দুইটা কপি কিনে ফেলেছি গত সপ্তাহে। বইটিতে দাম লেখা নেই। ধরে নিচ্ছি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট হরেক ধরনের কর্মচারী, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, এজেন্টসহ সবারই কাজে লাগবে। কিছু কপি নিশ্চয়ই বিলি করা হবে বিনে পয়সায়। এই সময়ের জন্য ম্যানুয়েলের ২৭৮-২৮৮ পৃষ্ঠায় ছাপানো ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এক অর্থে সাদামাটা বিধিমালা। নির্বাচনের আগে অর্থাৎ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন। অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দল, মনোনয়নপ্রত্যাশী, প্রার্থী, সমর্থক এবং অন্যান্য ব্যক্তি কে কী করতে পারবেন বা পারবেন না, তার বেশ বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে এই বিধিমালার মোট ১৯টি বিধিতে। কিছু ফিরিস্তি অনেকেরই জানা হয়ে গেছে।
উক্ত বিধিমালার ৮ বিধি অনুযায়ী কোনো প্রকার ট্রাক, বাস কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে কোনোরূপ শোডাউন করা যাবে না এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও সকল প্রকার মিছিল বা শোডাউন করা নিষেধ। বিধি ১২তে বলা আছে, ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের শুধু তিন সপ্তাহ আগে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা যাবে। অর্থাৎ আজ ১ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা চালানো নিষেধ। কিন্তু পত্রপত্রিকায় খবর দেখছি, কিছু কিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে শোডাউন করা হয়েছে, কোথাও কোথাও জোরেশেরে নির্বাচনী প্রচারণামূলক কাজ শুরু হয়ে গেছে। যেমন প্রথম আলো ৩০ নভেম্বরের কাগজে ৫ পৃষ্ঠায় একটা খবরের শিরোনাম হলো ‘সাংসদ এনামুলের আচরণে বিধি মানার লক্ষণ নেই’।
অন্যদিকে এই খবরও দেখলাম যে বিধিমালার কোনো লঙ্ঘনই সিইসির নজরে আসেনি। তাই ভাবছি, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালাটা দেশের বাইরে বেড়াতে চলে গেছে কি না। বিধিমালা বেড়াতে গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন লাটে উঠতে পারে। এখন থেকেই এই আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন কঠিনভাবে দমন না করলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই বাড়তে থাকবে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন এখন থেকেই কঠোর না হলে ১০ দিন পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা এবং বহু মানুষ নিহত ও আহত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেক বড় বড় নেতা অনেকবার।
এই বিধিমালা লঙ্ঘনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিধি ১৭(৪) এ ‘নির্বাচনী তদন্ত কমিটি’ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাপার হলো, নির্বাচন কমিশন ২৫ নভেম্বর একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সারা দেশে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, সহকারী জজ ইত্যাদি) সমন্বয়ে মোট ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি কমিটির এখতিয়ারভুক্ত এলাকাও এই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই নির্বাচনী তদন্ত কমিটির তালিকা শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ মোটেও যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনকে পত্রপত্রিকায় ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে জানাতে হবে। দরকার হলে কুমিল্লা জেলার নির্বাচন তদন্ত কমিটির নাম-ঠিকানা কুমিল্লার সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন দিতে হবে। অর্থাৎ জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে সবাইকে জানাতে হবে, যাতে আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জানতে পারেন, তিনি অভিযোগ নিয়ে কোথায় যাবেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯১ক ধারায় বলা আছে যে নির্বাচনী তদন্ত কমিটিকে তদন্ত শেষ করতে হবে তিন দিনের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত নির্বাচন ম্যানুয়েলটি ভালো হয়েছে। অবিলম্বে অন্তত ১০টি কপি দেশের ৬৪টি জেলার বার লাইব্রেরিতে পাঠাতে হবে।
মোদ্দাকথা, নির্বাচন কমিশন চোখ-কান বন্ধ রেখে আচরণ বিধিমালাকে এখন বেড়াতে পাঠিয়ে দিলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিধিমালা, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি আনুষঙ্গিক ব্যাপারে প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা আজ থেকেই নিতে হবে। এর দায়িত্ব শুধু এবং একমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপর।
ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।