সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত নির্ভয় ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। আগে যা–ই ঘটুক না কেন, তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মী–সমর্থকদের আচরণ সংযত হবে, কাউকে ভয়ভীতির মধ্যে থাকতে হবে না, সেটাই প্রত্যাশা ছিল। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও সে রকম আওয়াজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর বেশ কিছু দিন চলে গেলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি যে খুব বদলায়নি, সেটাই জানা গেল সংবাদমাধ্যমের খবরে। বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার। একদিকে গায়েবি মামলার কারণে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা এখনো তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, হুমকি দিয়ে চলেছেন।
বরিশালের গৌরনদীতে পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান শরীফ ভয়ভীতির কারণে বাড়িতে থাকছেন না। এ অবস্থায় গত বুধবার রাতে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে তাঁর খোঁজ করেন। যখন তাঁরা জানতে পারেন তিনি বাড়িতে নেই , তখন তাঁরা হুমকি দেন যে ৩০ ডিসেম্বরের আগে যেন বাড়ি না ফেরেন। একই ঘটনা ঘটেছে উপজেলা যুবদল সভাপতি স্বপন শরীফের বাড়িতেও। এ ব্যাপারে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা সাফাই গাইতে গিয়ে যা বলেছেন, তা হাস্যকর। তাঁদের দাবি, বিএনপি ইস্যু তৈরি করার জন্যই এই কাণ্ড করে থাকতে পারে। যেখানে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেখানে এলাকায় না গিয়ে তারা ইস্যু তৈরি করবে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। আর পুলিশও অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে দায় এড়িয়ে গেছে।
এর আগে গৌরনদী পৌরসভার মেয়র হুমকি দিয়েছিলেন যে বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন এলাকায় এলে তাঁকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হবে। স্বপন এখনো নিজের এলাকায় যেতে পারেননি। তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বরিশাল শহরে। প্রথম আলোয় এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মেয়র পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে খবরের প্রতিবাদ করলেও প্রতিবেদনের কোথায় ভুল তথ্য আছে, তা দেখাতে পারেননি। তাঁর এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকম ভয়ভীতি বা হুমকির ঘটনা শুধু এই দুটি উপজেলায় ঘটেছে, তা নয়। আরও অনেক স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি গায়েবি মামলা, পুরোনো নাশকতার মামলায় বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারের পর জামিন নেওয়ার জন্য তঁাদের স্বজনদের আদালত চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। আবার মামলায় জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় বিএনপির একাধিক প্রার্থীকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।
এ অবস্থায় কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায়? প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা তফসিল ঘোষণার পর সবকিছুই নাকি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেছেন। এটাই কি নিয়ন্ত্রণের নমুনা?
নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু এসব ঘটনায় তার উল্টো চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছেন। এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিরোধী দলের প্রার্থীদের যাতে মামলা ও হামলার ভয়ে পালিয়ে না থাকতে হয় কিংবা ক্ষমতাসীন দলের কেউ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে আসতে না পারেন, এটা নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন মুখেই শুধু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে। বাস্তবে কিছুই করছে না। এই নিষ্ক্রিয়তা ও নিস্পৃহতার সংস্কৃতি থেকে নির্বাচন কমিশন বেরিয়ে আসতে না পারলে, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং এসব অন্যায় আচরণ বন্ধ হোক।