একাদশ সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবু বকর ওরফে আবু হত্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মধ্যে যে অভিযোগ পাল্টা–অভিযোগ চলছে, তা একেবারেই অনভিপ্রেত। তিনি একটি ইউনিয়ন পরিষদের চার দফা নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। একজন জনপ্রতিনিধি যে দলেরই হোন না কেন, তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক কাম্য হতে পারে না।
পুলিশের ভাষ্য থেকে জানা যায়, আবু বকর বিএনপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের জন্য ঢাকায় এসে মেট্রোপলিটন হোটেলে উঠেছিলেন ১৫ নভেম্বর এবং ১৮ নভেম্বর সকালে তিনি হোটেলের ভাড়াও শোধ করেন। ওই দিন রাতে আবু বকর হোটেল থেকে বেরিয়ে যান এবং পরদিন বুড়িগঙ্গায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। নিহত ব্যক্তির পরিবার সূত্রে বলা হয়, তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর অপহরণকারী পরিচয়ে তাঁদের কাছে টাকা চাওয়া হয় এবং পরে অপহরণকারীদের দেওয়া ১০টি বিকাশ নম্বরে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। আবু বকরের ভাতিজা জানান, ১৮ নভেম্বর রাত ৮টা ৫০ মিনিটে আবু বকরের কাছ থেকে ফোন আসে, যাতে তিনি তাঁকে কেউ মেরে ফেলতে চায় বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
যেকোনো হত্যাই মর্মান্তিক এবং তা নিয়ে রাজনীতি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। হত্যারহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের ধরে বিচারে সোপর্দ করা সরকারের দায়িত্ব। থানায় অভিযোগ আসার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা তদন্ত করে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। তাদের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বিকাশের যে ১০টি নম্বরে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেসব নম্বরের সূত্র ধরে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা কঠিন কাজ নয়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচনকালীন সরকারের পুলিশ একজন বিরোধী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীর হত্যার ঘটনা উদ্ঘাটনে আদৌ আন্তরিক কি না। অথবা সে জন্য শ্রম ও মেধা খাটাতে রাজি আছে কি না। আমাদের পুলিশ বাহিনী এত দুর্বল নয় যে সুনির্দিষ্ট সূত্র থাকা সত্ত্বেও তারা অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সমস্যার মধ্যে পড়বে।
আবু বকর হত্যার ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। বিএনপির দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে গেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে বলেছেন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আবু বকর খুন হয়ে থাকতে পারেন, তার পক্ষেও তিনি কোনো তথ্য হাজির করেননি। একটি হত্যার ঘটনা নিয়ে এ ধরনের বাদানুবাদ পুলিশের তদন্তকাজকে যেমন ব্যাহত ও প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি ঘাতকেরাও থেকে যেতে পারে লোকচক্ষুর আড়ালে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা আবু বকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও তদন্তের সাফল্য সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার পর জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে যাওয়ার কথা থাকলেও তাদের কাজকর্মে এর ন্যূনতম প্রতিফলন টের পাওয়া যায় না। বরং নির্বাচন কমিশন যেসব কর্মকর্তাকে নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োগ করেছে, পুলিশ বিভাগ অযাচিতভাবে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সন্ধানে ব্যস্ত। পুলিশের এসব তৎপরতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির অন্তরায় বলে মনে করি।
আবু বকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত না হলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আরও বাড়বে, মানুষ ভয়ভীতিতে থাকবে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। বিএনপির পক্ষ থেকে আবু বকর ছাড়াও দলের কয়েকজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। এর সবগুলো তদন্ত করে দেখা উচিত।