গত শুক্রবার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল নিয়ে সৃষ্ট সংঘর্ষের ঘটনা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ও অত্যন্ত দুঃখজনক। এই
সংঘর্ষে সোহেল আহমেদ নামের এক ট্রাকশ্রমিক নিহত এবং পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। দীর্ঘ সময় সেতুতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীসাধারণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে। দেশের অন্যতম ব্যস্ত এই সেতুর টোল নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি সহজেই এড়ানো যেত, যদি কর্তৃপক্ষ সমস্যাটি সম্পর্কে ঔদাসীন্য না দেখাত।
প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল বা মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ছিল অযৌক্তিক। যেকোনো সেতুর মাশুল নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যার উদ্দেশ্য নির্মাণ খরচ উঠিয়ে নেওয়া। ১৯৮৯ সালের ১৫ মার্চ চালু হওয়ার পর থেকে এই সেতুতে যে বিপুল পরিমাণ মাশুল আদায় করা হয়েছে, তা অনেক আগেই এর নির্মাণ ব্যয়ের সীমা ছাড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তারপরও যদি সরকার মনে করে থাকে যে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সার্বিকভাবে পরিবহন খাতের উন্নয়নের জন্য মাশুল বহাল থাকা দরকার, সেটি পুরোনো হারে করাই সমীচীন ছিল। কিন্তু তা না করে গায়ের জোরে অযৌক্তিক মাশুল চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ২১ অক্টোবর আলম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে তিন বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার পর থেকে। এই প্রতিষ্ঠান কার ও মাইক্রোবাসের মাশুল ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা, অটোরিকশার মাশুল ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা পুনর্নির্ধারণ করে। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয় পণ্যবাহী ট্রাকের মাশুল। আগে যে ট্রাকের মাশুল ছিল ৩৫ টাকা, সে ট্রাকের মাশুল করা হয়েছে ২৪০ টাকা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো যে শ্রমিক সংগঠন মাশুল বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলন করেছে, তারা সরকারের সমর্থক; যে প্রতিষ্ঠান মাশুল আদায়ের ইজারা পেয়েছে, সেটিও সরকারি দলের নেতার মালিকানাধীন। অভিযোগ আছে, পুলিশ ও শ্রমিক সংঘর্ষের সময় এই প্রতিষ্ঠানের লোকজনও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা ফাঁকা গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে। সোহেল তাদের গুলিতে মারা যাননি। তাহলে কাদের গুলিতে মারা গেছেন, শ্রমিকদের বাইরে সেখানে আর কারা ছিল, সেসব খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারেরই।
উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল আদায় নিয়ে সংঘর্ষ ও সংঘাতের ঘটনা এবারেই প্রথম নয়। ২০১৫ সালেও একবার সেতুর টোল বাড়ানো হয়েছিল। পরে পরিবহনশ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বর্ধিত টোল প্রত্যাহার করা হয়। এখন তিন বছর পর আবার সেতুর মাশুল কয়েক গুণ বাড়িয়ে প্রাণঘাতী পরিস্থিতি কেন তৈরি করা হলো, তার জবাবও কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে।
কথায় বলে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাধ্য না হলে কিছু করে না, সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে এখন তারা মাশুল ছাড়াই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি আগে থেকে পরিবহন সংগঠন, ইজারাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে মাশুলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে হয়তো এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো যেত। সেতুর মাশুল আদায়ের সঙ্গে শুধু সেতু ব্যবস্থাপনা নয়, পুরো পরিবহন খাতের লাভক্ষতি, ভোক্তা ও যাত্রীসাধারণের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে হবে। ট্রাকের মাশুল বাড়ালে শেষ পর্যন্ত তার দায় শোধ করতে হবে ভোক্তাদেরই। কাউকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেতুর মাশুল বাড়ানো যাবে না।
নিহত ট্রাকশ্রমিক সোহেল আহমেদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক; যদিও কোনো আর্থিক মূল্যে জীবনের ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।