কথা তো এমনই ছিল। তিনি সমাহিত হতে চেয়েছিলেন নিভৃত পল্লি শেলাবুনিয়ার গির্জার সামনে। স্থানটি ছিল তাঁর খুবই প্রিয়, আর সাধু পলের গির্জাটি তাঁরই হাতে গড়া। কী দেখেছিলেন আর কিই-বা পেয়েছিলেন ফাদার মারিনো রিগন সুন্দরবনঘেঁষা মোংলার এই সুবিধাবঞ্চিত নোনা জনপদ থেকে?
মারিনো রিগনের কথাতেই বলি, দেখেছিলেন দারিদ্র্য, শিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যের অভাব। কিন্তু পেয়েছিলেন অফুরন্ত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। তিনি বাংলাদেশে ছিলেন ১৯৫৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এই দীর্ঘ ৬১ বছরের জীবনযাপনে মনেপ্রাণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি। ভালোবেসে হৃদয় ও মনে ধারণ করেছিলেন বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে।
আমার বাবার সঙ্গে কীর্তন গান নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনার সূত্রে সখ্য থাকায় আমরা ভাইবোনেরাও তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি অনেক। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা আমাদের এগিয়ে দিয়েছে কেবলই সামনের দিকে। পত্র যোগাযোগ তাঁর সঙ্গে সব সময়ই ছিল। ২০০১ সালে ভেনিসে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয় এবং তখনই তিনি পরিবারের সদস্যদের জানান, তাঁর মৃত্যু হলে যেন তাঁকে বাংলাদেশে সমাহিত করা হয়।
পত্রে তাঁর এ কথা জানতে পেরে সেদিন প্রবাসে বসে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ২০০৩ সালের শেষার্ধে নিউজিল্যান্ড থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে আমি ও আমার স্বামী তাঁর সঙ্গে দেখা করে শরীরের খোঁজখবর নিলে তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘ভালো আছি, তবে হৃদয়টা খুব লাফালাফি করে।’
সেদিন গল্পের মাঝে বারবার তিনি অনুযোগ করছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক হতে চাই, অনেক চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। আমি চাই তুমি আমার জন্য একটু চেষ্টা করো।’ খোঁজখবর করতে থাকলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোথায় তাঁর আবেদনটি জমা আছে। তবে কোনো হদিস করতে পারলাম না। নতুন করে কাগজপত্র নিয়ে আবেদন জমা না দিতেই আমি বদলি হলাম জামালপুরে। ফিরলাম ২০০৭ সালে। এর মধ্যে তিনি আমাকে তাগিদের ওপরেই রাখলেন। কেন এত দেরি ইত্যাদি প্রশ্নে আমি কেবলই অপরাধ বোধ করি। তবে এবার জোর প্রচেষ্টা নিয়ে মাঠে নামলাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব সনদ পেলেন। তাঁর সে কী আনন্দ!
প্রস্তাব দিলাম, একটু দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সনদ গ্রহণের ব্যবস্থা করি? তিনি বললেন, ‘অনেক দেরি হবে, তোমার কাছ থেকেই নেব।’ দাঁড়ালাম ক্যামেরার সামনে, হয়ে গেল সনদ হস্তান্তর। এই সনদ নিয়ে তিনি পাসপোর্টের আবেদন করে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেলেন, যা তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী ছোট্ট হাতব্যাগে বা পকেটে থাকত। সুযোগ পেলেই সবাইকে দেখাতেন তাঁর এই অমূল্য পরিচিতিটি।
ফাদার মারিনো রিগন একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক হলেও তাঁর বিচরণ ও পরিচিতি রয়েছে বহুবিধ ক্ষেত্রে। তিনি একজন সমাজকর্মী, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, লেখক-অনুবাদক, শিক্ষাবিদ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সংগঠক ও সহায়তাকারী। রবীন্দ্রনাথ ও লালন ছিলেন তাঁর মন ও হৃদয়জুড়ে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে তাঁকে প্রদান করা হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।
ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে বাবা রিকার্ডো এবং মা মনিকার আট সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন মারিনো। তাঁর জীবিত ভাইবোন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাছে মারিনো একজন অতিশয় প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষ। ২০১৩ সালে আমি তাঁদের পৈতৃক বাড়িসহ অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাই। মারিনোর জন্য তাঁদের পরম মমতা থেকেই পৈতৃক বাড়িটিকে রূপান্তরিত করেছেন ‘বাংলাদেশ মিউজিয়াম’-এ এবং সিটি কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়ে বাড়ির পেছনের সড়কটির নাম দিয়েছেন Road Tagore।
আজ বলতে দ্বিধা নেই যে ফাদার মারিনো রিগন ক্রমেই দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলেন এই দেশের অস্থিমজ্জায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে। ২০১৪ সালে তিনি মারাত্মক হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি জনসমক্ষে এক কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন, ‘যেতে পারি, তবে আমার মৃত্যু হলে আমাকে বাংলাদেশে এনে সমাহিত করতে হবে।’ জেনেছি, যত দিন স্মৃতিশক্তি নিয়ে বেঁচেছিলেন, একটি কথাই বলতেন, ‘আমি শেলাবুনিয়ায় যাব।’
ভাইবোন এবং আত্মীয়-পরিজনকে স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি সমাহিত হবেন শেলাবুনিয়ার সাধু পলের গির্জার সামনে। তাঁর পরিবার একটি বছর সময় নিয়েছে ঐকমত্যে পৌঁছাতে। অবশেষে হার মেনেছে তাঁর কাতর ইচ্ছার কাছে। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ছিল তাঁর অন্তিম প্রয়াণ। ঠিক এক বছর পর ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে তিনি যাত্রা শুরু করবেন বাংলাদেশের মোংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রামের উদ্দেশে। তাঁর এই যাত্রা হবে কফিনবন্দী হয়ে, আসছেন তিনি সমাহিত হতে!
কে, কবে শুনেছেন বিদেশি একজন নাগরিক সমাহিত হতে চান বাংলাদেশে? বরং মৃত বিদেশিকে নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থাই প্রচলিত। ফাদার মারিনো রিগনের অন্তিম ইচ্ছাপূরণে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ব্যবস্থা সুসম্পন্নের নির্দেশ দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই তাঁকে।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে জাতীয় পতাকাশোভিত হয়ে তিনি সমাহিত হতে যাচ্ছেন ২১ অক্টোবর। আর প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসা ও চোখের জলে চিরবিদায় জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে মোংলার আমজনতা। তবে তিনি আমাদের চোখের আড়ালে গেলেও মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবেন।
ড. নমিতা হালদার এনডিসি, বাংলাদেশ সরকারের সচিব (পিআরএল)