জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা একে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ ও ‘জনসমর্থনহীন’ বলে সমালোচনা করে আসছিলেন। তাতে এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক ছিল যে নতুন এই জোট নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মাথাব্যথা যথেষ্ট আছে। আর শুধু নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সরকারের প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকছে না। জোটের কর্মসূচিতে বাধা দিতে প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সিলেটে ২৩ অক্টোবর যে সমাবেশ আহ্বান করেছিল, মহানগর পুলিশ কমিশনার তার অনুমতি দেননি। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা প্রথমে সিলেট রেজিস্ট্রি মাঠে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। রীতি অনুযায়ী সমাবেশের জন্য আবেদন জমা হলেই ধরে নেওয়া হয় যে অনুমতি পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী ঐক্যফ্রন্ট প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার মহানগর পুলিশ কমিশনার ‘সমাবেশের অনুমতি দেওয়া গেল না’ বলে আবেদনকারীদের জানিয়ে দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে পুলিশ যে যুক্তি দিয়েছে, সেটি খুবই হাস্যকর। মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপির যে নেতাদের নামে সমাবেশের অনুমতির আবেদন করা হয়েছিল, তাঁদের নামে অনেক মামলা আছে। এ অবস্থায় সমাবেশের অনুমতি দিলে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের ঠুনকো অভিযোগে কোনো দল বা জোটকে কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ার অর্থ হলো তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ঘরোয়া সভা করার অনুমতি চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
সরকারের এই পদক্ষেপ থেকে মানুষ এটাই ধারণা করবে যে যাঁরা প্রতিপক্ষকে গণবিচ্ছিন্ন বলে উপহাস করছেন, তাঁরাই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। কে গণবিচ্ছিন্ন আর কে গণসম্পৃক্ত, সেটি প্রমাণের উপায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনী হাওয়া অনেকটা জোরেশোরে বইতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন জোট ও দলের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই সভা–সমাবেশ করে বেড়াচ্ছেন। জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা ডেকেছেন, কিন্তু তাঁর নামেও তো এখনো একাধিক ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। তিনি যদি মামলার আসামি হয়ে সমাবেশ করতে পারেন, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা পারবেন না কেন?
সংবিধানে সব নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ করার অধিকার স্বীকৃত। বিরোধী দলকে যদি সংবিধান–স্বীকৃত এই অধিকার ভোগ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করা যায় না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একদিকে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাবেন, অন্যদিকে পদে পদে তাঁদের বাধা দেবেন, এই আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নির্বাচনের পূর্বশর্ত যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা, তা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো বর্তমান বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশ মেনে নিয়েও যখন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী, তখন তাদের সভা-সমাবেশের ওপর অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং এর ফলে রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ও জবরদস্তিমূলক আচরণ ত্যাগ করা উচিত।
সব পক্ষের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। সুতরাং তেমন একটি নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বে সব পক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ভোগের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করা সরকারের একান্ত দায়িত্ব। আমরা আশা করব, সিলেট মহানগর পুলিশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আবেদনটি পুনর্বিবেচনা করবে, নির্ধারিত দিনেই তাদের সমাবেশ অনুষ্ঠানের অনুমতি দেবে। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পুলিশকে বাধা দেওয়া উচিত নয়।