গত সোমবার মন্ত্রিসভায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৭’ নামে যে নতুন আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, তা কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপব্যবহারের যে প্রবণতা আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছি, নতুন আইনের কয়েকটা ধারা নিয়েও একই আশঙ্কা রয়েছে। নতুন আইন বরং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে সাংবাদিক মহলের অনেকে মনে করছেন। অন্যদিকে আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর সামগ্রিকভাবে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
৫৭ ধারায় বিচারযোগ্য অপরাধগুলো নতুন আইনের চারটি ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে দণ্ডের মাত্রা কিছুটা কমানো হলেও নিরপরাধ মানুষের হয়রানির ঝুঁকি কমেনি। ন্যূনতম দণ্ডের বিধান তুলে দেওয়া এবং কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে আসামির জামিন লাভের সুযোগ রাখাকে ৫৭ ধারার পর্যায় থেকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’, ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ ইত্যাদি বিষয় সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার কাজটি খুবই জটিল ও কঠিন। ফলে এসব প্রত্যয়ের মনগড়া ব্যাখ্যার সুযোগ নিয়ে এ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা–সম্পর্কিত ২১ নম্বর ধারাটির সর্বোচ্চ দণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। দণ্ডের এই উচ্চমাত্রা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে লক্ষণীয় ধারাটি সম্ভবত ৩২, যেখানে কম্পিউটার বা ডিজিটাল মাধ্যমে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ বলে বিবেচিত হবে, এমন অপরাধের বিচারের বিধান রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ এবং এই অপরাধের সর্বোচ্চ দণ্ড ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
আমাদের বিবেচনায়, এই ধারা অত্যন্ত কঠোর এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকারের পরিপন্থী। এখানে ‘অতিগোপনীয়’ ও ‘গোপনীয়’ তথ্য-উপাত্ত আরও সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। এই ধারার সুযোগে তথাকথিত দাপ্তরিক গোপনীয়তার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা শেষ বিচারে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পরিপন্থী এবং অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে, এমন সমুদয় অপরাধের বিষয়ে যথাযথ আইন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে আইনের কোনো অংশ যেন কালাকানুনে রূপ নিতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখাও একান্ত প্রয়োজন।