জাহানারা ইমাম ছিলেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। তিনি ছিলেন সুন্দর এক জীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন বহনকারী, যে জীবন-স্বপ্ন বাঙালি নারীদের স্বভাবগত, গড়ে তুলবেন সুখী গৃহকোণ, পিতা–মাতা, স্বামী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবৃত্ত মিলে জীবন হবে সুন্দর ও সার্থক। সেই সঙ্গে যুক্ত থাকে আরও কিছু চাওয়া, কল্যাণময় হোক সবার জীবন, দেশ ও সমাজ যেন পেতে পারে মুক্ত ও স্বাধীন বিকাশের সুযোগ। তবে আপন জীবনবৃত্তে জাহানারা ইমাম কতক বাড়তি গুণের অধিকারী ছিলেন, সামাজিক জীবনে তিনি বিপুলভাবে আগ্রহী এবং চরিতার্থতা খুঁজে পেয়েছিলেন শিক্ষকতায়, পঠনপাঠনে আর কিঞ্চিৎভাবে লেখালেখিতে। যৌবনের সূচনায় তিনি কিছুকাল শিক্ষকতা করেছেন ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলে, যেখানে আনোয়ারা বাহার চৌধুরী প্রধান শিক্ষয়িত্রী, রোকেয়ার হাতে গড়া এবং তাঁরই আদর্শবাহী, আছেন যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী এবং বিকাশোন্মুখ ছাত্রীর দল। ঢাকার জায়মান বাঙালি উচ্চবিত্ত শ্রেণির সদস্য হয়েও তাই শিক্ষকতাকে আঁকড়ে ছিলেন বহুকাল, সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রীর দায়িত্ব নিয়ে। বিদেশিদের বাংলা শেখার বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন কিশোর গল্প-উপন্যাস এবং অগ্রণী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার স্বামী শরিফ ও দুই পুত্র রুমী-জামিকে নিয়ে সুখী সংসারের কর্ত্রী তিনি।
একাত্তরে ইতিহাস আছড়ে পড়ল এলিফ্যান্ট রোডের কোণে ছোট্ট সুন্দর ‘কণিকা’ গৃহে, ইতিহাসের ডাকে সাড়া দিতে পরিবারটি দ্বিধা করেনি। পুত্র রুমী বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ হেলায় ঠেলে সরিয়ে ঝাঁপ দেয় মুক্তিযুদ্ধে, মায়ের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে। পুত্র রুমীর দুঃসাহসিক অভিযান ও জীবনদান, শোকগ্রস্ত স্বামী শরিফের অকালপ্রয়াণ জাহানারা ইমামের সাজানো সংসার তছনছ করে দিল। ইতিহাসের ঘটনাধারায় পর্যুদস্ত না হয়ে তিনি ধীরে ধীরে শোক আত্মস্থ করে আবার জীবন গড়ার সাধনায় ব্রতী হলেন, রুমীকে খুঁজে পেতে চাইলেন সব মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে, নিজ বেদনার রূপ দেখলেন হাজারো পরিবারের আত্মদান ও ত্যাগে। আপন শোক সংহত করে লিখতে শুরু করলেন একাত্তরের দিনগুলি, সচিত্র সন্ধানী সাময়িকীতে এর ধারাবাহিক প্রকাশ তৈরি করল অভাবিত আলোড়ন, গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া নবীন-নবীনাদের আবার তা ফিরিয়ে আনল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয়।
একাত্তরের দিনগুলো রচনা, এর প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়া পাল্টে দিয়েছিল জাহানারা ইমামকে, তিনি হয়ে উঠলেন সব শহীদের জননীসম, বিপুল ভালোবাসায় মণ্ডিত, শ্রদ্ধায় আপ্লুত। ইতিহাস-অস্বীকৃতির উদ্গাতারা গণহত্যার প্রতীক গোলাম আযমকে আবার যখন সমাজে ও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তখন জাহানারা ইমামের ওপর অর্পিত হয় গণ-আদালত গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভার। রাষ্ট্রীয় শক্তিতে যারা ইতিহাস মুছে দিতে সক্রিয় ছিল, তারা দেখতে পেল, সমাজের শক্তিতে ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন। কোনো জাতির জীবনে গণমানুষের শক্তিতে এমন অসাধারণ অর্জন আর বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। জাহানারা ইমামের এই ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসকে দুই পর্বে চিহ্নিত করে গণ-আদালত-পূর্ব এবং গণ-আদালত-পরবর্তী ইতিহাস।
জাহানারা ইমাম আজ নেই, কিন্তু তাঁর অর্গল ভাঙা পথ বেয়ে জাতি এগিয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনী রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, একে একে সম্পন্ন হচ্ছে বিচার। মূল হোতারা ইতিমধ্যে হয়েছে দণ্ডিত, আদালতে হেঁট-মুণ্ড বসতে হয়েছে গোলাম আযম গংকে, অভিযুক্ত পক্ষের উকিলেরা গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার করতে পারেনি, কেবল বলতে চেয়েছে, মান্যবর, অপরাধ ঘটেছে, তবে আমার মক্কেল জড়িত ছিলেন না। গণহত্যার অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে আজকের প্রজন্ম যখন বিপুলভাবে অবস্থান নেয় রাজপথে, সৃষ্টি করে গণজাগরণ, তখন সবার ওপর জ্বলজ্বল হয়ে শোভা পায় শহীদজননীর প্রতিকৃতি, তাঁর আশীর্বাদ যেন ঝরে পড়ছে নবীন তরুণদের ওপর। জাহানারা ইমাম পথনির্মাতা ও পথপ্রদর্শক, তিনি যে পথ কেটেছেন, তা অবলম্বন করে এখন এগিয়ে যেতে হবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি প্রতিষ্ঠার পথে।
কীভাবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী তথা জেনোসাইডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হতে পারে, সে প্রশ্ন সমাধান করে অগ্রসর হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় এই বিচারের প্রশ্ন জোরদারভাবে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম ও রায়, প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশনের ভূমিকা, সাক্ষীদের অবদান ইত্যাদি নানা বিষয় বিশদভাবে তুলে ধরা দরকার। জেনোসাইড সংঘটনের জন্য রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক শক্তির আঁতাত, মহৎ ধর্মাদর্শের চরম অবমাননাকর বিকৃতি ও অপব্যবহার এবং এসবের পেছনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের ভূমিকা আদালতের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে তীক্ষ্ণভাবে উঠে এসেছে এবং তা ব্যাপকভাবে মেলে ধরা দরকার। বিচারের মাধ্যমে বিপুল তথ্য-উপাত্ত, দলিলপত্র এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ জড়ো হয়েছে। এসব উপাদান নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্ম, তারা সংগঠিতভাবে যত দুর্বলই হোক, তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি নাগরিক সমাজের সেই সব প্রতিনিধিকে, যাঁদের সঙ্গে শাহরিয়ার কবির ও নির্মূল কমিটির যোগাযোগ রয়েছে। আরও স্মরণ করি আহমেদ সালিমের কথা, যাঁর উদ্যোগে লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছে জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির উর্দু সংস্করণ।
জেনোসাইডের জন্য দায়ী পাকিস্তানিদের বিচারের দাবি আজ যখন তোলা হবে, তখন তা কেবল ১৯৫ যুদ্ধবন্দীর তালিকায় সীমিত থাকতে পারে না, অভিযুক্ত হতে হবে শীর্ষ পাকিস্তানি সমরনায়কদেরও, যাদের পাঁচজনকে দায়ী করে বিচারের কথা পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশনও উত্থাপন করেছিল। বিচারের দাবি যখন জোরেশোরে সামনে চলে আসবে, তখন বিচারের পথ কোনো না কোনোভাবে খুলে যাবে। সেই নির্ভরতার পরিচয় ইতিহাসে দাখিল করে গেছেন জাহানারা ইমাম ‘গণ-আদালত’ গঠন দ্বারা। এই গণ-আদালত নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইতালিভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল বা পিপিটি। ব্যাপক নৃশংসতার যেসব ঘটনা বিচারের বাইরে রয়ে যায়, পিপিটি তা বাস্তবায়নে কাজ করে। প্রতিবছর তারা একটি করে ঐতিহাসিক নৃশংসতার শুনানি ও বিচারের ব্যবস্থা করে। দুই বছর আগে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার। জেনোসাইডের জন্য দায়ী পাকিস্তানি অপরাধীদের এমনিভাবে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে দাঁড় করানোর জন্য যথোচিত প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সেই দায়িত্ব সম্পাদনের প্রত্যয় ও প্রেরণা আমরা খুঁজে পাই জাহানারা ইমামের জীবন ও কর্মে। তাঁকে নিয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আমাদের পথচলার তাই বিরাম নেই।
মফিদুল হক লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক