ইসির প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অব্যাহত বাগ্‌যুদ্ধকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অস্বাভাবিক বলা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ভোটে জয়ের জন্য একে অপরের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু দেখার বিষয়, সেই মানসিক চাপ যাতে সুষ্ঠু পরিবেশ কোনোভাবেই ব্যাহত না করে। আর সেই দায়িত্ব বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন দল এবং বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নিতে হবে। সরকারি দলের চাপ তারা কীভাবে সামলাবে, সেটাই দেখার মুখ্য বিষয়।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে ইসি এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি যাতে জনগণ, বিশেষ করে ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা খুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু তাতে খুলনার ভোটাররা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর ইসি থেকে যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে খুলনায় পাঠানো হয়েছে। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহযোগিতার প্রশ্ন কেন এল? যদি সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যৌক্তিক ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ থাকে, তবে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তো নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।

একজন উপসচিবের কাজে সহযোগিতা করার জন্য যুগ্ম সচিবকে পাঠানোর বিষয়টি কেবল দৃষ্টিকটু নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি মানসিক প্রচণ্ড চাপও বটে। আর যদি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার আগের রাজনৈতিক পরিচয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে থাকে, তাহলে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকেই নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে খুলনার ডিআইজি ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আপত্তি মেনে যদি ইসি সেখানে বিশেষ কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে বিএনপির দাবি অনুযায়ী সেখানকার দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকেও তো প্রত্যাহার করা উচিত।

নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ইসির প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। কিন্তু ইসি নিজেই যদি তার কাজে নিরপেক্ষ না থাকতে পারে, তাহলে অন্যদের নিরপেক্ষ থাকতে বলার নৈতিক জোরও থাকে না। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। ভোট অনুষ্ঠানের আগেই যদি প্রতীয়মান হয় যে ইসি কারও প্রতি পক্ষপাত করছে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ঢাকা উত্তর ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে ইসির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের নির্বাচন স্থগিত হলেও এই ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ইসির ব্যর্থতার বিষয়টি পরিষ্কার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং আগামী ২৮ জুনের মধ্যে ভোট গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ও কঠোর অবস্থান প্রত্যাশিত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের কাজে–কর্মে ধারাবাহিকভাবে তা নিশ্চিত করতে অসমর্থ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

গাজীপুর নির্বাচনের বাধা কাটলেও আপাতত সব নজর থাকবে খুলনার নির্বাচনে দিকে। সেখানে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই ইসিকে নিতে হবে। আশা করি, ইসি তার সেই যথাদায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হবে না। সেখানে জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে, সেই নিশ্চয়তা ইসিকে দিতেই হবে। একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর কাছ থেকেও যথা ভূমিকা প্রত্যাশিত।