পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির পক্ষের একজন প্রচারকর্মী হিসেবে আমার কাছে অভিজাত শ্রেণির ইঙ্গিতময় শব্দ নেই। আমি সোজাসাপ্টা ভাষায় বলব। সারা দুনিয়ায় এখন প্রায় ১৫ হাজার পরমাণু ওয়ার হেড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রূঢ় সত্য হলো সেগুলো অকেজো করে ফেলার মানে এই দেশগুলোর নেতাদের ক্ষমতাকেই অকেজো করার নামান্তর। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে আরও সোজাভাবে বলতে দিন: আমাদের এখনকার নেতারা এত বেশি আবেগতাড়িত যে তাঁদের হাতে পরমাণু অস্ত্রের মজুত সুরক্ষিত থাকবে, আমরা তা বিশ্বাস করতে পারি না।
গত বছর আমার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। সংগঠনের পক্ষে পুরস্কার নেওয়ার সময় আমি নোবেল কমিটিকে বলেছিলাম, পরমাণু অস্ত্রগুলো হচ্ছে পুরুষ পাগলদের হাতে থাকা একেকটি বন্দুক, যেগুলো আমাদের কপালের দিকে স্থায়ীভাবে তাক করে রাখা হয়েছে এবং সেই পাগলদের হাতের আঙুল ট্রিগারের ওপর ধরা আছে।
আমার পক্ষে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখানো সম্ভব নয়, এমন সব কারণে পরমাণু অস্ত্র এখন পুরুষের ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে তাঁদের (পরমাণু বোমার) বোতামের ‘সাইজ’ নিয়ে বড়াই করেছেন। অস্ত্রের আস্ফালন করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও কম যাননি। তিনি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন, তাঁদের হাতে বিশ্বের অন্য সব দেশের চেয়ে আধুনিক পরমাণু অস্ত্র আছে।
পরমাণু অস্ত্র নিয়ে এই বাগ্যুদ্ধ যদি শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে সেটি কম দুশ্চিন্তার কারণ হতো। কিন্তু এই তিন নেতাকে এমন সব ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হচ্ছে, যে সিদ্ধান্তগুলো সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে। যেমন, সম্প্রতি ট্রাম্প একটি বিধ্বংসী বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং স্টিল প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসার পর ওই নির্বাহীরা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে শুল্ক আরোপ দেশের জন্য খুবই ভালো ধারণা। এখন যদি উত্তর কোরিয়ায় পরমাণু হামলা এবং ইরানকে সেই যুদ্ধে টেনে নিয়ে আসার পক্ষে যুক্তি দেওয়া লোকজনের সঙ্গে ট্রাম্প বৈঠকে বসেন, তাহলে কী হবে? সেই ধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের মানুষ জন বোল্টন তো এখন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা!
কে ক্ষমতায়? নারী নাকি পুরুষ? আমি সেই তর্কযুদ্ধ বাধাতে চাই না। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে, সে বিষয়টি বিবেচনার বাইরে রয়ে গেছে। আমি বলছি না, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সব পুরুষই অস্থিতিশীল মানসিকতার। ইতিহাসে বহু দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান থাকারও উদাহরণ আছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামনে যে চিত্র আছে, তাতে দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের নয়টি পরমাণু অস্ত্রধারী দেশের মধ্যে একমাত্র ব্রিটেন ছাড়া আটটি দেশেই সরকারপ্রধান হিসেবে আছে পুরুষ। এসব পুরুষের মধ্যে ট্রাম্প, পুতিন ও কিমের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিলে বলা যায়, এই গ্রহের পরমাণু অস্ত্র ভয়ানক লোকদের হাতে রয়েছে।
অবিবেচনাপ্রসূত বাগাড়ম্বর করার জন্য আমি এই তিন নেতাকে দায়ী না করে বরং সব দোষ জীববিজ্ঞানের ওপর চাপাব। হয়তো তাঁরা তাঁদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে কারও কথায় আহত হলে বা প্রতিপক্ষের হুমকি শুনলে উত্তেজিত আচরণ করতে শুরু করেন। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আমি হয়তো বলব, নিজেদের প্রকৃতিগত স্বভাবের বিরুদ্ধে কিছু করা যেকোনো লোকের পক্ষেই খুব কঠিন কাজ। শুধু এই যুক্তিতে কিম, ট্রাম্প ও পুতিনকে দায়মুক্তি দেওয়া সেক্সিস্ট বা যৌনবৈষম্যবাদিতা হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এটি সেক্সিস্ট ইস্যু হতে পারে, কিন্তু জেন্ডার ইস্যু নয়।
ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, বহু বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল নেতা বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের একেবারে কানায় নিয়ে গেছেন এবং সৌভাগ্যবশত সেখান থেকে তাঁরা আবার ফিরেও এসেছেন। অতীতের যেসব সতর্কবার্তা তাঁদের চূড়ান্ত বিপদ থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে সেসব সতর্কবার্তা আজকের দিনে কাজ করবে কি না, সে বিষয়ে আমি ততটা নিশ্চিত নই।
মনে রাখতে হবে, একনায়ক, স্বৈরশাসক এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নারী অথবা পুরুষ প্রেসিডেন্টের হঠকারিতা কিংবা আবেগের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাষ্যমতে, পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে ধ্বংসলীলা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এ রকমের একটি ঝুঁকি নিয়ে আমরা কীভাবে সামনে এগোব? একটাই জবাব: সব অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
বিয়াত্রিস ফিন নোবেল শান্তিজয়ী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস