দুর্বল গণতন্ত্র সবল করতে কয়েকটি প্রস্তাব

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া এবং ব্রেক্সিট গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া-এ দুটি ঘটনায় গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা কতটুকু আছে, তার পরীক্ষা হয়ে গেছে। ভুয়া খবর ও অগণিত প্রযুক্তি কোম্পানির কারসাজির কারণে এই ফলাফল হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

ব্রেক্সিট বিতর্ক যুক্তরাজ্য সরকারকে উভয়সংকটে ফেলে দিয়েছে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে পুনরায় ভোট গ্রহণের বিষয়টি যদি রাজনীতিকেরা অনুমোদন করতেন, তাহলে এর মাধ্যমে মূল ব্রেক্সিট ভোটকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে ঘোষণা করা হতো। আর এখন ‘পুনরায় ভোট হবে না’ বলে দেওয়ার কারণে মনে হচ্ছে ব্রেক্সিটের ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা লোকদের কোনো দিনই চুপ করিয়ে রাখা যাবে না। ফলে এই ইস্যুতে যুক্তরাজ্য যে সিদ্ধান্তই নিক, তা গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।

যুক্তরাষ্ট্রে গত নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক ও সাধারণ জনগণ যেভাবে সমালোচনা করেছেন, তা দেশটির রাষ্ট্রপ্রধানের পদের মান-মর্যাদাকে খাটো করেছে এবং এতে স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও উদার গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থা ক্রমবর্ধমান গতিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণের হার পড়ে যাচ্ছে এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস কমছে।

প্রশ্নবিদ্ধ এই গণতন্ত্র রাজনীতিকে মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনীতিকদের মিথ্যাচারকে পুঁজি করে নির্বাচনের ফলকে অগ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা বাড়ছে। ভুয়া অথবা অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতেই ভোটাররা তাঁদের প্রার্থী পছন্দ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঠিকঠাক তথ্য না পাওয়ার কারণেই ব্রেক্সিট ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশকারী এবং পুনরায় ভোট অনুষ্ঠানের দাবিকারীদের গায়ে স্বৈরাচারী কায়দায় ‘জনগণের শত্রু’ তকমা এঁটে দেওয়া হচ্ছে।

ভিক্তর অরবান গণতান্ত্রিকভাবে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতালিতে রাজনৈতিক হানাহানি ও অনিশ্চয়তার কারণে এ বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পণ্ড হয়ে গেছে। অন্যদিকে, পোল্যান্ডের সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ও আইনের শাসন লঙ্ঘনসহ ইইউর ফান্ডিং পলিসি লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠেছে।

নিশ্চিতভাবেই আদর্শ গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে যতসংখ্যক সম্ভব ভোটার ভোট দেবেন এবং তাঁরা প্রার্থীদের বিষয়ে নির্ভুল তথ্য পাবেন। প্রার্থীরা নানাভাবে নিজেদের এবং প্রতিপক্ষের আস্থাযোগ্য তথ্য তুলে ধরবেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাঁদের লড়াইটা যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা চালানোর মধ্যে আটকে আছে।

এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে ভোটারদের বিবেচনাশক্তি ও প্রার্থীদের মান বাড়ানোর মিশন নিয়ে কাজ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশে অভিবাসীদের নাগরিকত্ব পেতে গেলে সরকার-নির্ধারিত নাগরিকত্ব-সংক্রান্ত পরীক্ষায় পাস করতে হয়। ঠিক একইভাবে, ভোটারদের প্রার্থী নির্বাচন ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান পর্যাপ্ত আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করা হয় না কেন? ভোটারদের যদি এ বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে ভোটদানের ক্ষমতা দেওয়া হতো, তাহলে এমন একটি নিম্নতম মান নির্ধারণ করা যেত, যার মাধ্যমে তাঁরা দক্ষ ও ভালো প্রার্থী বেছে নিতে সক্ষম হতেন।

এর মাধ্যমে ভোটাররা এই বার্তা পেতেন যে ভোট খুব সস্তা অধিকার নয়, এই অধিকার অর্জন করে নিতে হয়। এটি করা হলে শুধু ভোটাররাই নন, প্রার্থীরাও তাঁদের মানোন্নয়নে সচেষ্ট হবেন। নাগরিকতা ও প্রার্থী নির্বাচনের নিম্নতম জ্ঞান যাতে তাঁরা পান, সেটি নিশ্চিত করতে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয় সন্নিবেশ করা দরকার।

শুধু ভোটারদের পরীক্ষা নেওয়া হলে সেটি একদেশদর্শী হয়ে যাবে। রাজনীতিকদেরও পরীক্ষায় পাস করে প্রার্থী হতে হবে। এর ফলে ভোটার ও প্রার্থীর গুণগত মান বাড়বে এবং গণতন্ত্রের বৈধতা পাকাপোক্ত হবে।

দেশ গঠনে যোগ্য রাজনীতিকদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভালো করার জন্য এমপি অথবা সিনেটরদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এতে ভোটাররাও নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের গুণমান সম্পর্কে সহজে ধারণা পাবেন।

এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটা দারুণ উদাহরণ। সেখানে প্রবৃদ্ধি, আয় ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বোনাস দেওয়া হয়।

এসব সংস্কার করলেই কি ব্রেক্সিট কিংবা ট্রাম্পের নির্বাচনের মতো ফল আর হবে না? এটি করলে ফল যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তা বলা যাবে না। কিন্তু ফলাফলের পথ যে ভিন্ন হবে, তা বলাই যায়।

এতে প্রথমত, ভোটাররা উচ্চমানসম্পন্ন বিতর্ক দেখতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, প্রার্থীরা আরও বলিষ্ঠভাবে তাঁদের প্রচারকাজ চালাবেন। তৃতীয়ত, ভোটাররা প্রার্থী সম্পর্কে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাবেন।

এটি হলে নির্বাচনের ফলের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি বিস্তৃত হবে। নির্বাচিত নেতারা আরও বেশি স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজ করতে পারবেন। দিন শেষে গণতন্ত্রই উপকৃত হবে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

দামবিসা মোয়ে: বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ ও লেখক