হকিংয়ের শেষ বই
একালের আলোচিত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন স্টিফেন হকিং। ৭৬ বছরের দীর্ঘ জীবন শেষে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ মারা যান তিনি। বিজ্ঞানী পরিচয় ছাড়াও তাঁর আরেকটি পরিচয় ছিল—তিনি জনপ্রিয় লেখক। মৃত্যুর আগপর্যন্ত অবিরাম লিখে গেছেন। বিজ্ঞানের বহুল আলোচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে লিখছিলেন একটি বই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কাজটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সেই বই লেখা সম্পন্ন করেন তাঁর পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বিজ্ঞানী বন্ধুরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মেয়ে লুসি এবং কিপ থর্ন ও মার্টিন রিসের মতো বিজ্ঞানীরা। সেই বই গত বছর প্রকাশিত হয় ব্রিফ আনসারস টু দ্য বিগ কোশ্চেন শিরোনামে। আক্ষরিক অর্থেই এটি স্টিফেন হকিংয়ের শেষ বই। তাঁর চিন্তাভাবনার সারাংশও বলা যায়।
ছন্দের মিল দেওয়ার জন্য বইয়ের নামে ‘বড় প্রশ্ন’ বলা হলেও আসলে প্রশ্নগুলো দৈর্ঘ্যে বা আকারে বড় নয়; গুরুত্বে বড়। মহাজাগতিক কিছু প্রশ্ন ও হকিংয়ের জবাব নিয়ে এই বই। সেই সঙ্গে শুরুতে হকিং ব্যাখ্যা করেছেন, কেন এসব প্রশ্ন নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। হকিংয়ের মূল কাজ ছিল কৃষ্ণগহ্বর ও সিঙ্গুলারিটি নিয়ে। তাঁর গবেষণা শুধু যে কৃষ্ণগহ্বরকেই ব্যাখ্যা করেছে, তা নয়। মহাবিস্ফোরণের সেই প্রথম বিন্দুটির অবস্থা ও যৌক্তিকতার ব্যাখ্যাও করেছে। ব্যাখ্যা করেছে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটিকে—সবকিছু কীভাবে এল? হকিং যে এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবলেন, ভেবে ভেবে বিচিত্র ও অদ্ভুত সব সমাধানে পৌঁছালেন, এটা তিনি কেন এবং কীভাবে করলেন? এই ব্যাখ্যা ও উত্তরের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে বইয়ের মূল আলোচনা।
>বড় প্রশ্ন ছোট উত্তর
মূল: স্টিফেন হকিং
ভাষান্তর: আবুল বাসার
প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
১৬৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৩২০ টাকা।
মহাবিশ্বে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী কি আছে? আমরা কি চাইলে ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারব? এ রকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে হকিং মহাজাগতিক ইতিহাস ধরে নিয়ে যান ভবিষ্যতে। জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কি আদৌ টিকতে পারব পৃথিবীতে? যদি না পারি, তাহলে কি মহাজাগতিক কোনো বসতি গড়ে তুলতে পারব? হকিংয়ের চোখে ভবিষ্যতের আসন্ন বিপর্যয় স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। সংকটের তীব্রতা সম্পর্কে তিনি আমাদের সাবধান করেছেন। আমরা তাঁর কথার সত্যতা টের পাচ্ছি। পুড়ছে বন। গ্রিনহাউস গ্যাসে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বায়ুমণ্ডল। গলে যাচ্ছে বরফ। ধীরে ধীরে পৃথিবী পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। হকিং বলেন, ‘আমরা সবাই টাইম ট্রাভেলার। একসঙ্গে ছুটছি ভবিষ্যতের পথে। এত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তি দিয়ে আমরা যদি মানুষের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই না পারি, তাহলে এসবের আর অর্থ কী?’
হকিংয়ের এসব ভাবনা বাংলায় হাজির করেছেন আবুল বাসার। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯-এ বড় প্রশ্ন ছোট উত্তর নামে বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অনুবাদে দ্য থিওরি অব এভরিথিং বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। দুটি বই–ই প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। তাঁর অনুবাদ সহজ, স্পষ্ট। বিজ্ঞানের বইয়ে অনেক সময়ই ভাষার জড়তা চলে আসে। কারণ, এখানে লাইন ধরে অনুবাদ করলেই হয় না, বিজ্ঞানটুকুও বুঝতে হয়। অনুবাদক এ ক্ষেত্রে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে বিজ্ঞানের পরিভাষাগত বিভিন্ন শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে ‘তথ্যনির্দেশ’ নামে একটি অংশ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পাঠকের বোঝার জন্য এটি বেশ কাজে লাগবে।
কিছু জায়গায় বাক্য কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ একটু যেন তাল কেটে যায়। বানানের ভুল এর পেছনে একটি বড় কারণ। সম্পাদনায় আরও কিছুটা যত্নশীল হলে হয়তো এসব সমস্যা এড়ানো যেত। এটুকু বাদ দিলে বইটি বিজ্ঞানে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য সুখপাঠ্য। হকিংয়ের মনোজগতে উঁকি দিয়ে দেখার এই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।