হয়ে ওঠার গল্প
প্রত্যেক মানুষের একটা গল্প থাকে চিরায়ত, চিরন্তন গল্প। মোটাদাগে সেই গল্পটা লিখে ফেলা আধুনিক সাহিত্যের কাজের মধ্যে পড়ে না। আধুনিক সাহিত্য ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলো বিষয় করে তোলে। ব্যক্তির সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে বিদ্যমান থাকতেও পারে, না-ও পারে। সদ্য নোবেলজয়ী লেখক ওলগা তোকারচুক যে কারণে বলছেন, ধ্রুপদি সাহিত্যের মতো কোনো গল্পকে শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত বলে যাওয়ার রীতিতে আমরা (একালের লেখকেরা) বিশ্বাসী নই। কারণ, এটা সত্য নয়। কোনো কিছুই এমন সুন্দর একরৈখিকভাবে ঘটে না। ওলগার কথার স্বরূপ পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন, যখন শাহাদুজ্জামানের মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইয়ের গল্পগুলো পাঠ করবেন। গল্পগুলো সত্য হোক মিথ্যা হোক, ভালো হোক মন্দ হোক, শাহাদুজ্জামানের চোখ দিয়ে সমকালীন সমাজকে দেখার অসম্ভব এক শক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। গল্পবলার এই রীতিকে আমরা বলতে পারি ‘হয়ে ওঠার গল্প’। অর্থাৎ যে গল্প পূর্বনির্মিত নয়, নির্মাণের পথ ধরে এগোচ্ছে। এর যথার্থতা আমরা বুঝতে পারি ‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’ গল্পে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মতিন কায়সার লেখক, তিনি ‘একটা হয়ে ওঠা গল্প লেখার সংগ্রাম’ করছেন। তিনি কিছুতেই বানিয়ে তোলা গল্প লিখতে চান না। বইয়ের এই সূচনা গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা লক্ষ করি, যে গল্পটি লিখতে চাচ্ছেন মতিন, সেই গল্পেরই চরিত্র তিনি। শাহাদুজ্জামান সেই বানিয়ে তোলা গল্পটি যেন লিখে দেখাচ্ছেন, কেমন হতে পারে মতিনের অলিখিত গল্পটি। গল্পের মতিন জানাচ্ছেন, ‘কনফেকশনারি দোকানের নানা কিসিমের বিস্কুটের প্যাকেটের মতো নানা কিসিমের গল্পে তার বিশ্বাস নাই। প্রগতিশীল গল্প, মাটিলগ্ন গল্প, উত্তর-আধুনিক গল্প নয়, সে শুধু একটা হয়ে ওঠা গল্প লিখতে চায়।’ গল্পকার শাহাদুজ্জামানকে আমরা এই কথার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। এই বইয়ের গল্পগুলোকে খুব মোটাদাগে কোনো উত্তরাধুনিক গল্প বা বাস্তববাদী অথবা পরাবাস্তববাদী গল্প—এভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। শাহাদুজ্জামান গল্পগুলোতে অন্য একটা গল্পের সন্ধান করেছেন। বাস্তবে যা ঘটে, তার পেছনে কতগুলো অলীক ঘটনা থাকতে পারে কিন্তু শাহাদুজ্জামানের গল্পগুলো ঠিক অলৌকিক কিছু নয়, লৌকিকতার পেছনের সম্ভাব্যতার কোলাজচিত্র সেখানে উঠে আসে। কতগুলো অনির্দিষ্ট গল্প যেন নির্দিষ্ট সম্পর্কের খোঁজে যাত্রা শুরু করে, আর সেই হয়ে ওঠার পথের কোনো একটা বাঁকে লেখক দাঁড়িয়ে পড়েন, পাঠক চাইলে পথটা আরও এগিয়ে নিতে পারেন, পাঠকের সেই স্বাধীনতাটুকু লেখক দিয়ে দেন সুকৌশলে।
এ বিষয়ে দুয়েকটি গল্পের প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ গল্পে কথকের বাবা আইসিইউর বিছানায় শুয়ে। বাবা ফিরবেন, সে নিশ্চয়তা নেই। তার লাইফটাকে প্রলং করা হচ্ছে। মাঝখান থেকে নিঃস্ব হওয়ার পথে কথক। ভেন্টিলেটর খুলে দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে তাকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গল্পের কথক বাবার স্মৃতি, নিশ্চল বর্তমান ও অনিশ্চিত সম্ভাবনার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকেন। একক কোনো ঘটনার বয়ান এটা নয়। শুরু কিংবা শেষও নেই। অনুরূপভাবে বইটির নামগল্পে একধরনের অব্যাখ্যাত চরিত্র বজলুকে আমরা পাই। পেশায় গাছি। পুঁথিপাঠ তার নেশা। সেই চরিত্র ঢুকে যাচ্ছে রাজধানীতে, সে কৌশলে একটি দুর্ঘটনার সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু একবারও তাকে প্রতারক বলে মনে হচ্ছে না। এর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একটি পুঁথির গল্প, যেখানে মামলার সাক্ষী দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে একটি ময়না পাখি। পুরো গল্পের সঙ্গে ময়না পাখির সাক্ষী হওয়ার বিষয়টির একটা সম্পর্ক আছে। পাঠককে সেই সম্পর্কটা নির্ণয় করতে হবে। গল্পকার কোথাও কিছু বলে দেননি। তিনি একটা হয়ে ওঠার গল্প যেন লিখে গেছেন।
গল্পে ভাষা ও উপমার ব্যবহারে চমক সৃষ্টি করেছেন লেখক। যেমন, ‘শায়লাকে এক বিকেলে ছাদের কার্নিশে বসে মুখে লিচু পুরে চুষতে দেখে ভালোবেসে ফেলেছিল মতিন কায়সার। শায়লার কণ্ঠ এমন অদ্ভুত যে শুনলে মনে হবে ভোর হচ্ছে।’ এমন খুব সাধারণ ডিটেইল গদ্যে সূক্ষ্ম উইট যুক্ত করেছে। যেমন একটি গল্পে কথক বলছে, ‘আমার বাবা সেই মানুষ, যার একই দিনে দুইবার পকেটমার হয়েছিল।’ আরেকটি গল্প শুরু হয়েছে এভাবে: ‘এক নারীর রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুরান ঢাকার জমজমাট, কৌতূহলোদ্দীপক জনপদের যুবক বলে, “চান্দের আলো হালায় মাইয়ার শরীরে ঢুইকা আর বারাইবার পারতাছে না।”...আবার এই জনপদের জনৈক ক্ষুব্ধ বাকরখানি বিক্রেতা চিৎকার করে বলতে পারে, “তোরে আমি টিকটিকি দিয়ে...”।’ গল্পগুলো লেখক এভাবে খুব হালকা চালে শুরু করেছেন। ছোটখাটো অনেক ঘটনা টেনে শেষ পর্যন্ত একটা গল্প তিনি লিখেছেন, যা ছোটগল্প পাঠে আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়।