২০ জুলাই ১৯৪৭। জন্ম হলো সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার। ৭২ বছর উত্তীর্ণ এ পত্রিকার প্রকাশনা বর্তমানে মাসে একবার, বিশেষ ঈদ সংখ্যা এবং বর্ষপূর্তি সংখ্যা—এভাবেই এখন প্রকাশিত হয় বেগম। প্রয়াত সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর মেয়ে ফ্লোরা নাসরীন খান।
বেগম-এর সূচনাপর্বে এর সম্পাদক ছিলেন প্রথিতযশা কবি সুফিয়া কামাল; এবং সেই সময় সদ্য লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করা ছাত্রী নূরজাহান বেগম ছিলেন সহযোগী সম্পাদক। তবে দৃশ্যমান এই দুই নারীর অলক্ষ্যে ছিলেন আরেকজন—সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। সওগাত প্রকাশের (১৯১৮) সংগ্রাম চালাতে চালাতে নারী জাগরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। আর সওগাত-এর ৭টি নীতির অন্যতম ছিল: ‘নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধাদি এবং “চিত্রে মহিলা জগৎ” প্রকাশ করা।’ সেই পত্রিকাটির সামাজিক-জাতীয় ঘোষণা ছিল, ‘নারী না জাগিলে জাতি জাগিবে না।’
মহিলা সওগাত-এ সে সময় ছবিসহ ছাপা হতো মুসলিম লেখিকাদের লেখা। অবশ্য প্রতিথযশা অন্য সম্প্রদায়ের লেখিকাদের লেখাও প্রকাশিত হতো এখানে। এমন সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, মহিলা সওগাত বন্ধ করে প্রকাশ করা হবে বেগম। সংক্ষেপে এই হলো পত্রিকাটির যাত্রা শুরুর প্রেক্ষাপট।
কলকাতায় ১২ ওয়েলসলি রোড থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকাটি ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মোকাবিলা করেছিল নানান সংকট। আজ পেছন ফিরে দেখলে কত কিছুই না দেখতে পাই: বেগম-এর প্রথম সংখ্যায় শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন শামসুন্নাহার মাহমুদ এমএ, মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, মিসেস এইচ এ হাকাম এমএলএ, বেগম সৈয়দা ফেরদৌস মহল সিরাজী, মিসেস জাহান আরা মজিদ, কাজী লুৎফুন্নেসা হারুন, বেগম ফিরোজা রহমান, বেগম জোবেদা খাতুন, মিসেস আমেনা চৌধুরী, মিসেস আনোয়ারা বেগম প্রমুখ।
১৯৪৭ থেকে ’৫০—এই তিন বছর কলকাতা থেকে প্রকাশিত বেগম-এর নিয়মিত বিভাগগুলো ছিল সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প-উপন্যাস, জীবনী, সচিত্র মহিলা জগতের খবর, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, সেলাই, রান্না, চিঠিপত্র, পুস্তক সমালোচনা, ছায়াছবির কথা, সংক্ষিপ্ত সংবাদ এবং কয়েকটি সচিত্র বিভাগ।
পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরই নূরজাহান বেগমকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন সুফিয়া কামাল। সে সময় নূরজাহান বেগমকে পত্রিকা চালাতে সহযোগিতা করেছিলেন লায়লা সামাদ, নাসিমা বানু ও তাহমিনা বানু।
বেগম–এর সূচনা সংখ্যা থেকেই এখানে নিয়মিত লিখতেন বিভিন্ন কবি–লেখকেরা। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, জাহানারা আরজু প্রমুখ। আর পয়লা সংখ্যা থেকেই সাঈদা খানম যুক্ত ছিলেন এ পত্রিকার আলোকচিত্রী িহসেবে।
আগেই বলা হয়েছে, ১৯৫০-এ পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল পত্রিকাটির প্রকাশনা। তো ঢাকায় স্থানান্তরিত এ পত্রিকার সম্পাদক হলেন নূরজাহান বেগম। তবে সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেও সারা জীবন বেগম-এর সব উদ্যোগের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন সুফিয়া কামাল ।
আমাদের সংবাদ ও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে নানা কারণেই বেগম গুরুত্ববহ। তার মধ্যে অন্যতম হলো—এক. দেশভাগের আগে এবং দেশভাগকালে অবিভক্ত বাংলার যে নিদারুণ রাজনৈতিক-সামাজিক-সাম্প্রদায়িক সংকট, সেখানে নারীর দুর্ভোগ ছিল অনেক বেশি। নারীদের সেই দুর্ভোগের বৃত্তান্ত বেগম-এর শুরুর দিকের সংখ্যাগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
দুই. ’৫০-এ ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর বেগম-এর সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধসমূহে প্রকাশ ঘটেছিল নতুন দৃষ্টিভঙ্গির—নারীর ভূমিকা শুধু ঘরেই নয়, বহির্জগতেও তাঁর ভূমিকা ও অবদান রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এ বিষয়গুলোর প্রতি এ সময় আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বেগম-এর ৭২ বছরে দাঁড়িয়ে এখন স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় যে নারীর অগ্রযাত্রায়, সর্বোপরি সমাজের আগুয়ানযাত্রায় বেগম নামের পত্রিকাটির অবদান পর্বততুল্য। কিন্তু আফসোস এই যে সংবাদ ও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এ পত্রিকাটিকে এখনো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে সাময়িকপত্রের সামগ্রিক ইতিহাসে বেগম এখনো শুধু ‘নারী সম্পাদিত নারীবিষয়ক পত্রিকা’। তার এ পরিচয়টিই প্রমাণ করে নারীর অধঃস্তনতা কীভাবে সমাজে পিতৃতান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের শিকার হয়ে চলেছে।
এক্ষণে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত নির্বাচিত বেগম : অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০ (প্রকাশকাল: ২০০৬)-এর ভূমিকায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথাগুলো মনে করা যাক: ‘এই পত্রিকার লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলিম নারীদের কাছে পৌঁছানো—তার চেয়ে বড়ো পরিসরে যদি যায়, তা হবে উপরি পাওনা। আশা করা গিয়েছিল, যাঁদের উদ্দেশে পত্রিকা প্রকাশ করা, এটি হয়ে উঠবে তাঁদের কণ্ঠস্বর। ...বেগম, দেখা যাচ্ছে খণ্ড ইতিহাসের প্রকাণ্ড আকর। ৫০ বছর বা তার কিছু বেশি কাল ধরে বাংলাদেশে নারী সমাজে যে ধীর অগ্রগতি হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধারণ করে রেখেছে এই পত্রিকা। ...বেগম-এ নারীর অগ্রগতির ইতিহাস যেমন ধরা পড়েছে, নারীর প্রতি বহু প্রতিকূলতার কথাও তাতে আছে। তবু শেষ পর্যন্ত মনে হয়, নারীর প্রগতি বোধ হয় আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।’
ড. আনিসুজ্জামানের কথাগুলো স্মরণ রেখে এবার বেগম প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়র দিকে তাকানো যাক। সম্পাদকীয়তে সুফিয়া কামাল পাঠক সমাজকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিলেন: ‘কৃষ্টির ধারা বহন ও সমৃদ্ধি সাধনের একমাত্র সহায় সাহিত্য, সেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজও আমরা প্রায় উদাসীন। মুসলিম নারীসমাজে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার হইতে পারে আমাদের নিজস্ব এমন কোনো বাহনের প্রতিষ্ঠা আজ পর্যন্ত হয় নাই। বর্তমানের এই নবজাগরণের দিনে, নতুন জাতীয় সংগঠনের যুগ সন্ধিক্ষণে মুসলিম নারীদের এই লজ্জাকর দারিদ্র্য আরও করুণ চেহারায় আমাদের অন্তর ব্যথিত করিয়া তুলিয়াছে। এই জন্যই বহুবিধ বাধা–বিঘ্ন ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সাপ্তাহিক বেগম মুসলিম নারীসমাজের খেদমতে হাজির হইল। ...সকলের সমবেত চেষ্টায় বেগম মুসলিম নারীসমাজের সত্যিকারের খেদমতের যোগ্য হইয়া উঠুক।’
নারী প্রগতির ক্ষেত্রে ২০০০ সাল অব্দি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বেগম। তবে এখানে শুধু নারীর ইতিহাস নয়, উঠে এসেছে আমাদের সমাজপ্রগতির ইতিহাসও।