বিভক্তিতে গুরুত্ব হারাচ্ছে ফোবানা
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের ঐক্য আর সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন দশক আগে ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা বা ফোবানা নামের সংগঠনটি সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। হাওর-নদী-সাগর পাড়ি দেওয়া স্বদেশিদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফোবানা তার যাত্রা শুরু করে। ফোবানা সম্মেলন উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের আনন্দ অভিযাত্রার তিলক হয়ে উঠে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এই সম্মেলনে অংশ নিতে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। আমেরিকা ও কানাডার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা যেমন ছুটে আসতেন, তেমনি ইউরোপ থেকে অতিথিরা এসে যোগ দিতেন এই সম্মেলনে।
নেতৃত্ব আর দখলদারির কবলে পড়ে আজ জৌলুশ হারিয়েছে ফোবানা। একই নামে আমেরিকার একাধিক শহরে ফোবানা সম্মেলন হয়েছে। ফোবানার আদলেই এনবিসি সম্মেলন নামে সর্ব আমেরিকান আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠে। এসব টানাপোড়েনের কারণে প্রবাসীদের ফোবানার প্রতি আগের সেই আবেদন আর নেই। তারপরও ফোবানার নাম শুনলে প্রবাসের লোকজন শিহরিত হোন। স্বপ্ন দেখেন, দূর দেশে নিজেদের ঐক্য আর সংহতির।
২০১৯ সালে ফোবানার ব্যানারে নিউইয়র্কে দুটি সম্মেলন হচ্ছে। দুই পক্ষের প্রস্তুতই চলছে। একই দিনে দুই পক্ষ ফোবানা সম্মেলন ডাকায় প্রবাসীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ৩০ ও ৩১ আগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর ফোবানা সম্মেলন করার ঘোষণা দিয়েছে দুই পক্ষই। এক পক্ষের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে লাগার্ডিয়া ম্যারিয়টে এবং অপর পক্ষের সম্মেলন হবে লং আইল্যান্ডের নাসাউ কলিসিয়াম সেন্টারে।
ফোবানার এক পক্ষের সঙ্গে নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশনের (এনএবিসি) ঐক্য প্রক্রিয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকার বেলাজিনো পার্টি হলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে আয়োজকেরা ঘোষণা দেন, এনবিসি ফোবানার সঙ্গে একীভূত হবে। সুতরাং আগামী বছর থেকে এনএবিসি আর থাকবে না। তবে এবার ফোবানা ও এনএবিসির সম্মেলনে সবাই অংশ নেবেন। এনএবিসি সম্মেলন হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আটলান্টায়। ফোবানা সম্মেলন হবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্কে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফোবানার এই পক্ষের স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন খান। তাঁর সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে আরও অংশ নেন এনএবিসির নেতা আবু লিয়াকত হোসেন, ফোবানার হোস্ট কমিটির আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ, সদস্যসচিব ফিরোজ আলম, স্টিয়ারিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী আজম প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, ‘বিভক্তি-বিভাজনকে বিসর্জন দিয়ে আমরা ও এনএবিসির নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়েছি। এখন থেকেই আমরা ঐক্যের পথে চলা শুরু করেছি। এক সময় ফোবানার যাত্রাপথে নিজেদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভক্তি ও বিভাজনের রেখা দেখা দেয়। এর ফলে ১৯৯৪ সালে ফোবানায় বিভক্তি দেখা দেয়। নানা উদ্যোগের পর ১৯৯৭ সালে ফোবানা ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৯৯ সালে আবার বিভেদ দেখা দেয়। এই বিভক্তির জন্য আমরা কাউকেই দায়ী করতে চাই না। এটিই ছিল ফোবানার ওই সময়ের পরিণতি। তারপরও ফোবানার চলার পথ থেমে যায়নি।’
লিখিত বক্তব্যে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ভাঙা সম্মেলন করার দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে ফোবানার অনেক অলংকার গা থেকে খসে পড়েছে। ফলে আমরা মূলধারার রাজনীতিতে নিজেদের সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। জাতীয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্প ও সাহিত্যকে তুলে ধরতে পারিনি। আমাদের অনেক সামাজিক সংগঠনকেও বিভক্তি আর বিভাজন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন আতিকুর রহমান সালু, গিয়াস আহমেদ, আলী ইমাম, ডা. মাসুদুর রহমান, ড. ইবরুল চৌধুরী, মাকসুদ এইচ চৌধুরী, মঞ্জুর হোসেন, ফারুক হোসেন মজুমদার, নুরুল আজিম, এজাজ আকতার তৌফিক, আবু নাসের, নিজাম রহিম, বদিউল আলম, ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার, বিল্লাল হোসেন, কামরুজ্জামান বকুল।
সংবাদ সম্মেলনের তথ্য জানার পর মীর চৌধুরী ও জাকারিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ফোবানার অন্য পক্ষ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যে ফোবানার যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটির সত্যিকারের উত্তরাধিকারী আমরাই। সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী আমরা গত ৩২ বছর ধরে বিভিন্ন শহরে ফোবানা সম্মেলন করছি। তারই ধারাবাহিকতায় আসছে সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক সিটি সংলগ্ন লং আইল্যান্ডে নাসাউ কলিসিয়ামে তিন দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। সেই সম্মেলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ থাকা কিছু লোক ফোবানার নামে তামাশা শুরু করেছেন। অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ফোবানার মূলধারা থেকে বহিষ্কৃতরাই কয়েক বছর আগে এনএবিসি চালু করেছিলেন। একইভাবে ফোবানার নির্বাচনে ভোট না পেয়ে ক্ষুব্ধ কিছু লোক পাল্টা ফোবানার নাটক করছেন। তাই জনবিচ্ছিন্ন এসব লোকজনের মধ্যেকার ঐক্যপ্রক্রিয়ার ফলাফল শূন্য।’
বিবৃতিতে প্রবাসীরা যাতে বিভ্রান্ত না হন, সে আহ্বান জানিয়ে চেয়ারম্যান মীর চৌধুরী ও নির্বাহী সম্পাদক জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ফোবানার নাম অবৈধভাবে ব্যবহার করে নিউইয়র্কে ২৪ ফেব্রুয়ারি যে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে, তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা ফোবানা কেন্দ্রীয় কমিটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, ফোবানা একটি ফেডারেশন। এটি পরিচালিত হয় একটি কনস্টিটিউশন ও অপারেটিং প্রসিডিউরের মাধ্যমে। এটি কোনো ব্যক্তির পরিচালিত সংগঠন নয়। যেকোনো সংগঠন ফোবানার কনস্টিটিউশন, বাই ল’জ ও অপারেটিং প্রসিডিউর মেনে ফোবানায় অংশ নিতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিউইয়র্কে কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে ফোবানার নির্বাচনে পরাজিত হয়ে এবং কেউ কেউ বহিষ্কৃত হয়ে সংগঠনের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাদের আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিউইয়র্কে যখনই ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখনই এই পক্ষ বিভিন্নভাবে সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করতে ফোবানার নাম ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান করার এবং কমিউনিটিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য শহরে যখন ফোবানা সম্মেলন হয় তখন তাদের দেখা যায় না। নিউইয়র্কে যে সংগঠনেই এরা যুক্ত হয়েছেন, সেই সংগঠনেই তারা বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন। তাই সর্বোচ্চ এই আইনের দেশে এই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত না করতে গণমাধ্যমসহ সবার প্রতি অনুরোধ করা হচ্ছে।’
নাসাউ কলিসিয়ামে অনুষ্ঠেয় ফোবানার গণমাধ্যম শাখায় রয়েছেন সাংবাদিক আবীর আলমগীর। তিনি বলেছেন, স্বপ্নটা অনেক। স্বপ্ন দেখলে, তবেই না বাস্তবায়নের পথে হাঁটা যায়। আর আমরাও ক্লান্তিহীন হাঁটছি। আমি, নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনের কথা বলছি। এই বিশাল সম্মেলনে আমরা এমন কিছু করার স্বপ্ন দেখছি যা গত ৩২টি সম্মেলনকে ছাপিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করবে। নাসাউ কলিসিয়াম আমেরিকার এমন একটি বিখ্যাত ভেন্যু যাতে এ দেশের প্রায় সব লিজেন্ড শিল্পী পারফর্ম করেছেন।
এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের যেসব শিল্পী এই মঞ্চে পারফর্ম করবেন, তারাও ইতিহাসের খাতায় নিজের নামটি লেখাবেন।
সামর্থ্য ও সংযোগের দিক থেকে উভয় ফোবানাকে ঘিরে যুক্ত হওয়া নেতৃবৃন্দ বেশ শক্তিশালী। তারা স্বপ্ন দেখেন, উত্তর আমেরিকায় ঐক্যের ফোবানা প্রবাসে বাংলাদেশিদের অহংকারের মিলনমেলা হয়ে উঠুক। সাধারণ প্রবাসীরাও এমন স্বপ্ন দেখেন। ফোবানার নামে নামে প্রবাসীরা আবার ঐক্যবদ্ধ হবেন, ভাগাভাগি করবেন নিজেদের আনন্দ-বেদনা—এমন আশা কি সুদূর পরাহতই থেকে যাবে?