পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি বিশ্বব্যাপী একটি ব্যাপক বিতর্কিত বিষয়। আমরা ষাট থেকে আশির দশকের দিকে ফিরে তাকালে দেখব, পারিবারিক কাজকর্ম ও শিশু লালনপালনই ছিল সেই সময়কার নারীর মূল কাজ এবং আর্থিকভাবে নারী তখন ছিল সীমিত, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। পুরুষের ওপর নারীর এই নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি তখন ছিল স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর নারীশিক্ষার প্রসার হয়, তারা আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়, তাদের চিন্তা-চেতনা বিস্তৃত হয় এবং নারী তার কর্মজীবন ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে শেখে। নারীর নির্ভরতার বিষয়টি তখন নতুন স্বাধীন নারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা দেখি না কেন, নারীর নির্ভরতা, বিশেষ করে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতা বিষয়টির সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতি-নীতির বিষয়টি জড়িত। সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা হলো অন্যখানে। এই নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি যখন একজন নারীকে আত্মসম্মানী ও আত্মবিশ্বাসী হতে বাধাগ্রস্ত করে, যখন একজন নারীর অতি নির্ভরশীলতার কারণে তার সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় কিংবা ব্যক্তিজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখনই নারীর নির্ভরশীলতার স্বভাবসুলভ আচরণটি নিয়ে আলোচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে।
সিনড্রেলা গল্পটি কম বেশি আমাদের সবারই জানা। একজন রূপবতী অসাধারণ গুণাবলির অধিকারী মেয়ে সিনড্রেলা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নিজের মেধার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। সৎ মায়ের সংসারে দিন–রাত হাড় ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বিষাদে ভারাক্রান্ত সিনড্রেলা মনে মনে খুঁজতে থাকে তার স্বপ্নের রাজকুমারকে, যে একদিন এসে তাঁকে সব দুঃখ থেকে মুক্তি দেবে। সিনড্রেলাকে এই পরিবার থেকে, সমাজ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে স্বর্গ রাজ্যে। একদিন সে তার রাজকুমারের খোঁজ পেয়েও যায়।
আমাদের সমাজে এমন অনেক নারী আছেন, যারা ঠিক সিনড্রেলার মতো অবস্থায় বেঁচে আছেন। কেউ পরিবারে সৎ মা দ্বারা শোষিত, কেউ সৎ পিতা। কেউ বা নিজ পরিবারে আপনজনের কাছে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার। কেউ আবার পিতৃ–মাতৃহীন ভাই-ভাবী বা আত্মীয়দের সংসারে নামে মাত্র আশ্রয়ের বদৌলতে পরাধীন জীবনযাপন করেন। গল্পের সিনড্রেলাকে উদ্ধার করতে রাজপুত্র পাওয়া গেলেও বাস্তবের সিনড্রেলাদের জন্য সব সময় রাজপুত্র পাওয়া যায় না। ফলে কি হয়? বাস্তবের সিনড্রেলারা সব সময় একটা মানসিক কষ্টে থাকেন, হতাশায় ভোগেন এবং তারা কোনো না কোনো রাজপুত্রের আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গিয়ে জীবনযুদ্ধে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন।
নিউইয়র্কের মনোবিজ্ঞানী কলেট ডাওনিং সিনড্রেলা গল্পটি অবলম্বনে নারীর মনের এই অবস্থাকে সর্ব প্রথম ‘সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম’ নামে নামকরণ করেন। সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম একটি আবেগতাড়িত মানসিক রোগ যা সাধারণত মেয়েদের হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত একজন নারী মনে করেন, তিনি একা ‘গুড ফর নাথিং’। তার দ্বারা স্বাধীন হওয়া বা স্বাধীনভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। তার মানসিক, আর্থিক ও শারীরিক যত্নের জন্য এমন একজনকে দরকার যে কিনা সিনড্রেলা গল্পের রাজপুত্রের মতো এসে তার সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে তাকে প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করবে। এ অবস্থায় একজন নারী নিজে চেষ্টা না করে, নিজেকে অন্যের মুখাপেক্ষী করে তোলেন। তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন কোনো একটি নির্দিষ্ট মানুষ বা কল্পনার রাজপুত্রের ওপর। মূলত এটাই সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম।
সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোমে ভুক্তভোগীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিজের ওপর আত্ম-বিশ্বাস বা আত্মমর্যাদার ঘাটতি বহন করা। এই সমস্যায় দেখা যায় একজন নারী তার জীবনসঙ্গিনীর ওপর খুব বেশি আস্থা রাখতে শুরু করেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এত বেশি একচ্ছত্র ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় জড়িয়ে পড়েন যে, জীবনসঙ্গিনীর কাছে তার আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যার ফলে সম্পর্কে খুব সহজেই তিক্ততা বা বিরক্তি চলে আসে। এ ধরনের নারীরা সাধারণত সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব স্পর্শকাতর ও আবেগী হয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিনড্রেলা সিনড্রোমের একজন নারী তার কর্মব্যস্ত স্বামীর সার্বক্ষণিক ব্যস্ততাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে ভাবেন যে, হয়তো তার স্বামী তাকে আর ভালোবাসেন না। তাই তাকে এড়িয়ে চলতে এমন ব্যস্ততা দেখান। অন্যদিকে, একজন স্বাভাবিক নারী হয়তো স্বামীর অতি ব্যস্ততার বিষয়টিকে শুধু বিরক্তির চোখেই দেখবেন।
বাইরের উন্নত দেশগুলোতে সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোমের চিকিৎসার্থে সাইকোলজিক্যাল বা মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি দেওয়া হয়। থেরাপির মাধ্যমে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতাকে কমিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অবগত নন। অসাধারণ মানুষদের মধ্যেও কতজন সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম বিষয়ে অবগত আছেন, তা জানা নেই। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে, সে বিষয়ে আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। তবে চেষ্টা করলেই আমরা সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোমের রোগীদের সহায়তা করতে ব্যক্তি-পরিবার ও বন্ধু মহল থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারি। আমরা যদি তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হই, তাহলেই রোগী অনেকটা সহায়তা পাবে।
সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোমে রোগীরা নিজেও পারেন নিজেদের সহায়ক হতে। নিজের সম্পর্কে উঁচু ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে খুব সহজেই আমরা অন্যের সঙ্গে মিশে যেতে পারি এবং সুন্দর ও সহজ একটা সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। অন্যদিকে, নিজের প্রতি নিচু ধারণা অবশ্যই আমাদের সামনে বাড়ার গতিকে রোধ করে। সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম থেকে নিজেকে রক্ষা করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পরিচালনায় নিজের প্রতি উঁচু আত্মসম্মান বা আত্মবিশ্বাস পোষণ করা খুবই জরুরি। বিপরীতমুখী চিন্তা–চেতনা আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং নিজেদের প্রতি নিচু আত্মবিশ্বাসের বা আত্মমর্যাদার জন্ম দেয়। নিজের দুঃখ-কষ্ট, ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে, কী হতে পারতাম বা অবস্থা কেমন হতে পারত তা না ভেবে, যেমন আছি, যে অবস্থানে আছি, আমাদের তাই নিয়ে সামনে এগোতে হবে। হয়তো আপনি দৌড়ে খুব দুর্বল। তার অর্থ এই নয় যে, আপনি অ্যাথলেটিকে পরাজিত। আপনি হয়তো বা টেনিসে দুর্দান্ত খেলবেন। হয়তো আমি পড়ালেখায় দুর্বল কিন্তু আপনি প্রচণ্ড মেধাবী। এখানে আমার নিজেকে আপনার থেকে ছোট মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি হয়তো শিল্পকলায় এতই জিনিয়াস যে, আপনি সেখানে নেহাতই অপরিপক্ব।
কাজেই সব সময় আমাদের বিপরীতমুখী চিন্তা-চেতনা বর্জন করে যেকোনো পরিস্থিতিতে ভালো দিকটা দেখতে হবে। অন্যের প্রতি উদার ও সহনশীল হতে হবে। নিজের প্রতি সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করতে হবে, নিজের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হবে। অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাসকে মজবুত করতে হবে। নানান প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণের পথ নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তবেই আমরা পারব সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম থেকে নিজেদের রক্ষা করতে।