এই পৃথিবী আমার দেশ
‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’। আমরা সবাই এই সোনার হরিণের পেছনে অনন্তকাল ধরেই ছুটছি। এই ছুটে চলা আগেও যেমন ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই ছুটে চলার নামই জীবন। কে না চায় এই সোনার হরিণ? সোনার হরিণ মানেই শিক্ষা, অর্থ, যশ, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, ক্ষমতা, আর প্রতিপত্তিকে হাতের মুঠোয় পাওয়া। এই পৃথিবীতে দাপটের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে এর সবকিছুই আমাদের দরকার। কিন্তু এসব করায়ত্ত করা মোটেও সহজ নয়। এর পেছনে প্রয়োজন মেধা, শ্রম আর অধ্যবসায়। মেধা, শ্রম আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে সুযোগও বড় একটি ফ্যাক্টর। এসব কিছুর সমন্বয় যার জীবনে ঘটে, সোনার হরিণ তার হাতে ধরা দেয়। তাকে আর হরিণের পেছনে ছুটতে হয় না।
এই সোনার হরিণের খোঁজেই যুগ যুগ ধরে মানুষ দেশান্তরী হয়েছে। পাড়ি দিয়েছে পাহাড়-পর্বত, অরণ্য আর সাগর। সেই পথও সহজ নয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অর্থসম্পদ ব্যয় করে, মেধা খাঁটিয়ে তবেই সম্ভব হয় এই দেশান্তর। সোনার দেশে এলেই যে সোনার হরিণ সবার হাতে ধরা দেবে, তাও না। এখানেও আছে হরিণের পেছনে ছোটা। যেহেতু সোনার দেশ, তাই হরিণীকে কবজা করার সুযোগ এখানে বিস্তর। শুধু চোখ কান খোলা রাখলেই হলো।
এবার ফিরে যাই নিজের কথায়। আমিও একসময় দেশান্তরী হয়েছিলাম। ছুটেছি সোনার হরিণের পিছু পিছু। দেখেছিলাম একটি ভিসামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন। চেয়েছিলাম আমার ছেলেরা বড় হবে সীমাহীন এক পৃথিবীর বুকে। তারা যেন গর্বের সঙ্গে বলতে পারে, ‘আমরা এই পৃথিবীর নাগরিক’। সে অনেক দিন আগের কথা। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে একদিন আমরা শেষবারের মতো ঢাকা ছেড়েছিলাম। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস আমাদের নিয়ে উড়ে গিয়েছিল সিঙ্গাপুরের পথে। মাঝে ঘুরপথে সিঙ্গাপুরে ১১ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি ছিল। সেই সুযোগে আমরা সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরটি ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। সবকিছু কী অদ্ভুত সুন্দর! একেবারে যেন ছবির মতো। নতুন, ঝকঝকে, চকচকে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, আহা আমাদের ঢাকা বিমানবন্দর যদি এমন হতো! নিজের মাতৃভূমি, জন্মভূমি নিয়ে গর্ব করতে কার না ইচ্ছে করে?
এরপর আমাদের আরও একটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি ছিল। সেটা ছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে। মাত্র দুই ঘণ্টা সময়। বাথরুম সেরে একটু ফ্রেশ হতেই অনেকটা সময় চলে গেল। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর তেমন করে আর ঘুরেফিরে দেখা হয়নি। তবুও স্বল্প সময়ে বিমানবন্দরটি দেখে মনে হয়েছিল, জার্মানি দেশটিও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেখতে। একজীবনে এত বড় পৃথিবী দেখা কজনের ভাগ্যে হয়? তাই অনন্ত তৃষ্ণা রয়ে যায় বিধাতার সৃষ্ট এই পরম সুন্দর পৃথিবীকে যতটা সম্ভব নিজের চোখে দেখার।
অবশেষে পৃথিবীর পথে উড়তে উড়তে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম। জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। স্বপ্নের শহর নিউইয়র্ক। সোনার দেশ, ডলারের দেশ আমেরিকা। সারা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এই দেশটির অবস্থান। সবার ধারণা এখানে এলেই সোনার হরিণকে পাওয়া সহজ। তাই আমেরিকার নামে সবাই মুখিয়ে থাকে। আমরা বিমানবন্দর লাউঞ্জ ছেড়ে বাইরে এলাম। আমার ১০ বছরের ছোট্ট ছেলে অমিতের সব উত্তেজনা মুহূর্তেই যেন ফিকে হয়ে গেল। তার প্রথম বাক্য হলো, ‘এটাই আমেরিকা! এখানেও তো ঘাস আর মাটি আছে! ধ্যাত, আমিতো ভাবছিলাম এখানকার সবকিছু সোনার তৈরি। আমার স্কুলের সবাই বলছিল, তোমরাতো সোনার দেশে যাচ্ছ। এই সেই সোনার দেশ?’
অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য এই দেশটি গড়ে উঠেছে সারা পৃথিবী থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে। সুখের কথা, দেশটি কখনো তার সেই মূলনীতি বা ভাবমূর্তি থেকে সরে দাঁড়ায়নি। নিয়মের কড়াকড়ি থাকলেও দরজা এখনো খোলাই আছে। সাদা, কালো, হলুদ আর বাদামি মিলে বিধাতার অপরূপ সৃষ্টির কী সুন্দর সহাবস্থান এই দেশটিতে। হিন্দু ,খ্রিষ্টান, মুসলিম, বৌদ্ধ বা ইহুদি—কেউ কারওর বিশ্বাসের পথে বাধা নয় এখানে। সরকার এখানে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত। সরকার এখানে জনগণের সেবক, প্রভু নয়। চাইলেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ তাদের সংবিধানে নেই। অতি দূরদর্শী সংবিধান প্রণেতারা বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশের জনগণের স্বার্থ সুনিশ্চিত করে গেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষ তাদের ‘বিল অফ রাইটস’ সম্পর্কে সচেতন।
শুরু হলো নতুন দেশে আমাদের নতুন জীবন। টিকে থাকার লড়াই। মনে মনে ভাবলাম, এ লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। কারণ, এটি ছিল বাক্স থেকে বেরিয়ে আসার আমার প্রথম প্রয়াস। নিজের চোখে সারা পৃথিবীটাকে দেখার স্বপ্নকে ভেঙে যেতে দেখতে দেখতে একসময় আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। আর দশটা লক্ষ্মী বাঙালি মেয়ে আর স্ত্রীর মতো ডোবাকেই সাগর মনে করে হয়তো বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সীমিত পরিসরের খাঁচার জীবনকে চ্যালেঞ্জ করে আকাশ বেছে নিলাম। সুমিত আর অমিত, আমার এই দুটি সন্তানের জন্য পৃথিবীর সব কটি দরজা আমি খুলে দিতে চেয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য, আমার জীবনসঙ্গী স্বামী পদবির মানুষটি আমার স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। তার মনের উদারতার কারণেই আমার পথচলা সহজ হয়েছিল। এই ভালো মানুষটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
আমেরিকা নামের এই দেশ আর দেশের মানুষগুলোর প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই দেশের সরকার আমাদের এই দেশটির নাগরিকের মর্যাদা দিয়েছে। দিয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা আর কাজ করার সুযোগ। নিউইয়র্ক শহর মুহূর্তের মধ্যে আমাদের আপন করে নিয়েছিল। পথ চলতে গিয়ে মনে হয়েছে, এ যেন আমারই দেশ। তুচ্ছ আর ছোট খাট কাজ করতে গিয়ে অনেক বড় মাপের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। টিকে থাকার সংগ্রামে যারা সাহায্য করেছে, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম, ভাষা বা গায়ের রং এখানে আমাদের জন্য কোনো বাধা তৈরি করেনি। পেছনে ঠেলে দেয়নি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়নি।
শুরুতে সপ্তাহের সাত দিনই কাজ করেছি! সপ্তাহের পাঁচ দিন সেলস অ্যাসোসিয়েট হিসেবে একটি আইসক্রিম স্টোরে একজন ইতালিয়ান আমেরিকান বসের আন্ডারে কাজ করতাম। ভিনদেশে এসে সর্বনিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়েও বসের ‘বসিং’ হজম করতে হয়নি। কারণ এই বসও জানত, তার পূর্বপুরুষেরা একদিন এভাবেই নবাগত হিসেবে এ দেশে এসেছিল। তাই তারা নবাগতদের মূল্য বোঝেন, তাদের সংগ্রামের কষ্ট জানেন। তাঁরা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। যেকোনো কাজকেই কাজ মনে করেন। এটাই এই দেশটির সৌন্দর্য।
উইকএন্ডে মৌরীয়া নামে একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্টে বিয়ে, জন্মদিন বা কোনো বিশেষ পার্টিতে কাজ করতাম। গভীর রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে কাজ শেষ করে যখন বাসায় আসতাম, দেখতাম, আমার ছেলে দুটি আমার পথ চেয়ে বসে আছে। আমার ১৬ বছর বয়সী ছেলে সুমিত তার বেতনের খামটা এনে আমার পায়ের কাছে রেখে দিত। তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেত। ১০ বছর বয়সের ছোট্ট অমিত দেখতে দেখতে নিজের চেষ্টায় একটি বিশেষায়িত স্কুল থেকে হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন করল। সেও নিজের থেকেই বুঝে নিয়েছিল, তাকেও কাজ করতে হবে। আমাদের পরিচিত অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী নিজে ডেকে তাঁর অফিসে অমিতকে কাজ দিয়েছিলেন। ইহুদি ধর্মের এই সাদা মানুষটি ধীরে ধীরে একসময় আমার ছেলের পথ চলায় একজন বন্ধু ও পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। আজ সে আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দের একজন সমান অংশীদার।
দেখতে দেখতে ১৭টি বছর পার হয়ে গেল। আমার জন্মভূমি থেকে বহু দূরের আটলান্টিক সাগর পাড়ের এই দেশটা আজ আমার নিজের দেশ। আমার ছেলেরা এ দেশের জল-হাওয়ায় বেড় উঠেছে। এ দেশের শিক্ষায় তারা আলোকিত মানুষ হয়ে উঠেছে। একজন সম্মানিত বিচারকের সামনে ডান হাত তুলে ঈশ্বরের নামে আমরা শপথ নিয়েছিলাম, এ দেশকে নিজের দেশ হিসেবে ভালোবাসব বলে। দেশের প্রয়োজনে দেশের পাশে, দেশের জনগণের পাশে থাকব বলে। জন্মভূমি যেমন নিজের দেশ, যে দেশ আমাদের খাদ্য, পানীয়, বাতাস আর সুচিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, শিক্ষার আলো দিয়েছে—সে দেশটিও আমাদের নিজের দেশ। জন্মভূমি বা মাতৃভূমির চেয়ে তার সম্মান বা অবদান কোনো অংশেই কম নয়। আমাদের জীবনে জন্মদাত্রী মা আর দুধমা এই দুই মায়ের ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আমার ছেলেরা রাত জেগে ক্রিকেট খেলা দেখে। বাংলাদেশ জিতলে তারা গর্বিত হয়। হেরে গেলে কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যায়। মাশরাফি, মোস্তাফিজ আর সাকিবের জন্য তারা যখন গর্ব করে, আমার মন তখন আনন্দে ভরে যায়। তারা তাদের জন্মভূমিকে ভালোবাসে, তারা জানে তাদের শিকড় কোথায়। তারা জানে, দেশ ছেড়ে আসা মানেই দেশকে ভুলে যাওয়া নয়।
আমার ছোট ছেলেটি তার গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট দিয়েছিল। পোস্টটা পড়ে আমার মনটা সেদিন ভীষণ আনন্দ আর গর্বে ভরে গিয়েছিল। আমার সেদিনের সেই ছোট্ট অমিত আজ জুরিস ডক্টর। ইতিমধ্যেই সে পেয়ে গেছে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের ক্লার্কশিপের মতো মর্যাদাপূর্ণ চাকরি। বড় ছেলে সুমিত কাজ শুরু করেছে একটি নামকরা আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিজনেস এনালিস্ট হিসেবে। আজ মনে হচ্ছে সত্যিই আমি কোনো ভুল করিনি। আমার ছেলেরা সোনার বাংলায় জন্ম নিয়েছে। সোনার দেশ আমেরিকায় বেড়ে উঠেছে। সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। সোনার হরিণ যেন আমাদের জীবনে নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। জীবনসংগ্রামে তারা একেকজন যোদ্ধা। তারা আমার হিরো। আমি তাদের ভালোবাসি। সম্মান করি।
এখনো স্বপ্ন দেখি ভিসামুক্ত পৃথিবীর। একটি কচ্ছপ বহু বছর বাঁচে। সেও স্বপ্ন দেখে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়াবার। ইগল বহু বছর বাঁচে, সেও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুনরায় নতুন জীবনে ফিরে আসে। অথচ আমরা মানুষেরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে জন্মালেও আমাদের জীবন কিন্তু খুব ক্ষণস্থায়ী। তবে আমরা কেন এত বাধা নিষেধের দেয়াল তুলে, হানাহানি করে আমাদের স্বজাতির জীবনকে এত বিপর্যস্ত করে তুলছি? এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেন এত জটিলতা? কেন আমরা প্রকাণ্ড এই পৃথিবীতে সব জাতের, সব রঙের, সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে একটি সুখী পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি না? কবে আমরা বলতে পারব, আমি কোনো খণ্ডিত পৃথিবীর মানুষ নই। আমাদের এই পৃথিবীই হলো আমার দেশ!