পঙ্গু হাসপাতালে একদিন
২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘ভারতে গিয়ে বিপাকে বাংলাদেশিরা’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশি কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যান। প্রতিদিন ৩০০ বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলে মাসে ৯ হাজার রোগী কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। কলকাতা ছাড়া দিল্লি, চেন্নাই, ভেলর, বেঙ্গালুরুসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন বাংলাদেশিরা যাচ্ছেন।
এ বছরের ১৭ জুন ‘ডেইলি স্টার’–এ প্রকাশিত ‘বিদেশমুখী রোগীদের ফেরানোর মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি’ প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন এ বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। এর কারণ হিসেবে পাওয়া গেল চিকিৎসক দেবী শেঠির বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ভারতে একই রকমের অনেক বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। ফলে রোগীদের সামনে অনেক বিকল্প থাকে। আজকাল রোগীরা যাচাই-বাছাই করতে চান। সেটা যেমন স্বাস্থ্যসেবার মানের বিষয়ে, তেমনি খরচের বিষয়েও। বাংলাদেশে এখনো রোগীদের সামনে পর্যাপ্ত বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা অত্যন্ত মানসম্পন্ন। তাই রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে তাই?
গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রচণ্ড পা ব্যথার সমস্যা নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) বহির্বিভাগে গেলাম। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটলাম। টিকিটে আমার জেন্ডার লিখেছে ফিমেল। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি তো ফিমেল না। কাউন্টারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি বললেন, এটা ব্যাপার না। একজন বললেন, ভাই, এটা নারীদের লাইন তো, তাই আপনার টিকিটেও ফিমেল লেখা হয়ে গেছে। বললাম, আমাকে বললেই হতো যে এটা নারীদের লাইন বা ওপরে লিখে রাখতেন নারী, তাহলে আমি এ লাইনে আসতাম না। আমি তো কোনো নারী দেখতে পাচ্ছি না, তাই টিকিট কাটতে এসেছি। আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে তাঁরা নিজেরা গপ্প শুরু করলেন।
নীরবে চলে গেলাম ১১ নম্বর কক্ষে। সেখানে সিরিয়াল মেইনটেইনের জন্য দায়িত্বশীল মানুষ থাকা সত্ত্বেও কোনো সিরিয়াল নেই। এলোমেলো অবস্থা; কোথায় কার কাছে টিকিট জমা দিতে হবে যাঁরা জানেন, তাঁরা দ্রুত জমা দিচ্ছেন; আর যাঁরা জানেন না, তাঁরা নানাজনের কাছে জিজ্ঞাসা করছেন এবং পেরেশান হচ্ছেন। হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসবেন এটাই স্বাভাবিক। রোগীদের সব রকমের সহযোগিতা করা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব; অথচ সহযোগিতা সহজে মেলে না এমনকি সহযোগিতা যাঁর কাছে চাওয়া হবে, তাঁর সঙ্গে কথা বলাই দায় হয়ে যায়।
আমি টিকিট জমা দেওয়ার পর আমাকে ডাকা হলো। চিকিৎসকের ব্যবহার ভালো। তিনি আমাকে এক্স–রে করার জন্য পরামর্শ দিলেন। এক্স–রে ফিল্ম নিয়ে আবার তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য বললেন।
এক্স–রের জন্য টিকিট কাটতে গেলাম। দায়িত্বশীল নারী কড়াভাবে বললেন, আড়াই শ টাকা হাতে রাখেন। টাকা দেওয়ার সময় ৫০০ টাকার নোট দিলে তিনি বললেন, আপনাকে তো আড়াই শ টাকা রেডি রাখতে বলেছিলাম; তিনি টাকা প্রায় ফেরত দিয়ে দিচ্ছিলেন। বললাম, ভাংতি নেই কী করব বলেন? তখন নারী চুপ হয়ে টিকিট দিলেন এবং আড়াই শ টাকা ফেরত দিয়ে বললেন এক্স–রের জন্য ১০৭ নম্বর কক্ষে যান। সেখানে গিয়ে বেধে গেল বিপত্তি। এক্স–রের জন্য টিকিট জমা দিয়ে সিরিয়াল দিতে হয়। এখানে টিকিট জমা দিয়ে সিরিয়াল রক্ষার দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে কিন্তু টিকিট জমা নেওয়া হচ্ছে না। সবাই এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছেন, কখন টিকিট জমা নেবে সে জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রায় ৩০ মিনিট দাঁড়িয়েও টিকিট জমা দিতে পারলাম না। গেলাম এক্স–রে কক্ষে। সেখানে গিয়ে দেখি এসি দিয়ে পানি পড়ে পানি জমে আছে; এক-দুজন পানিতে স্লিপও খেলেন। অপেক্ষমাণ অন্যান্য রোগীর সামনেই নারী-পুরুষ, চলছে সবার এক্স–রে। দাঁড়িয়ে থেকে এবং এদিক–ওদিক হাঁটাহাঁটি করে ৫০ মিনিট শেষ হয়ে গেল কিন্তু টিকিট জমা নিচ্ছেন না তাঁরা। বিব্রতকর এক পরিস্থিতি!
পায়ের ব্যথা নিয়ে আর কত হাঁটা যায় বা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে অস্থির হয়ে টিকিট কাউন্টারে ফিরে বললাম, এক্স–রে কক্ষের অবস্থা তো খুব কঠিন, আমার টাকা কি ফেরত দেওয়া যাবে? তিনি বললেন, টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। আমি বললাম, টিকিটে তো আপনার স্বাক্ষর করার স্থান রয়েছে কিন্তু সেখানে শুধু কম্পিউটারে নার্গিস আক্তার লেখা রয়েছে, আপনার তো কোনো স্বাক্ষর নেই; আপনি কি নিয়ম মানছেন? তিনি বড় বড় চোখে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কথাই বললেন না!
২৫০ টাকার এক্স–রে প্রাইভেট হাসপাতালে ৬০০
২৫০ টাকা জলে গেল। পাশে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে এক্স–রে করাতে গেলাম, সেখানে ২৫০ টাকার এক্স–রে ৬০০ টাকা। বাধ্য হয়ে সেই টাকায় এক্স–রে করিয়ে প্রায় পৌনে দুইটার দিকে আবার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য গেলাম। দেখি চিকিৎসক চলে গেছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বললাম, দুইটা তো বাজেনি, তাতেই চিকিৎসক চলে গেলেন? উত্তর দিলেন, ‘রোগী না থাকলে চিকিৎসক থাকব কিল্লাইগা।’ অথচ ৪০ মিনিট আগেই এক্স–রে কক্ষের কত ভিড় ছিল, সবাই মিলে কী দ্রুত কাজ সেরেছেন! ১০ নম্বর কক্ষে দায়িত্ব পালন করতে থাকা চিকিৎসক বেশ মানবিক। তিনি সব বুঝতে পেরে আমাকে ডেকে নিয়ে ওষুধ লিখে দিলেন।
স্ট্রেচার বহন করছেন রোগীর লোকজনই
এ ছাড়া বহু পুরোনো স্ট্রেচারে করে রোগী বহন করা হচ্ছে। রোগীকে রোগীর লোকই স্ট্রেচারে করে আনা–নেওয়া করছেন, এ কাজের জন্য চোখে পড়ল না হাসপাতালের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের! বহুতল ভবন হয়েছে, ভবনের অনেক স্ট্রাকচার পরিবর্তন হয়েছে; পরিবর্তন হয়নি শুধু আচার–আচরণের এবং উন্নতি হয়নি মানবতার।
সরকারি হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা এবং স্টাফদের রূঢ় আচরণের কারণে অনেকেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেতে চান না। আর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে মানুষ যেতে চান না অনেক সময় বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগে। দক্ষ চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমাদের দেশে থাকা সত্ত্বেও মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হয়ে পড়েছেন। ছোটখাটো বিষয়েও চিকিৎসার জন্য ভারতে চলে যাচ্ছেন প্রচুর বাংলাদেশি!
এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন, সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হওয়ার জন্য এবং স্টাফদের আচরণগত সততা ও উন্নতির জন্য প্রয়োজন কাউন্সিলিং।
২০১৬ সালের প্রথম আলো ও এ বছরের ১৭ জুন ‘ডেইলি স্টার’–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের উল্লেখ করেছিলাম এ জন্যই।
** আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ যুবায়ের, কল্যাণপুর, ঢাকা