পাহাড়ে, আহা রে!
‘ড্রাগন শুধু চীন বা জাপানে নয়, এই বঙ্গ মুলুকেও কিন্তু থাকত,’ নুজহাতের উদ্দেশে বললাম আমি। সে তখন বগা লেকের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমার কথা শুনে সন্দেহের চোখে তাকাল। ‘বগা মানে জানিস তো?’ আমি বলতে লাগলাম, ‘বগা মানে হলো ড্রাগন। আগে এখানে কোনো হ্রদ ছিল না, চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এর মধ্যে কোথা থেকে এক রথে চড়ে হাজির হলো এক বগা। এসেই শুরু করল তার তাণ্ডব। আশপাশের সব সম্প্রদায়ের শিশু ধরে নিয়ে যেতে লাগল। ওরাই–বা কম যায় কিসে? ওদের সব যোদ্ধা মিলে হাজির হলো বগাকে নির্মূল করতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বগা বেচারা যে রথে চড়ে এসেছিল, সে রথে চড়েই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। কিন্তু পালিয়ে তাকে যেতে দেওয়া হলো না, রথে আগুন লাগিয়ে দিল তরুণ যোদ্ধারা। বগা সেই আগুনে পুড়ে মরল বটে, কিন্তু মরার আগে শেষবারের মতো আগুনের ফোয়ারা ছোটাল সে। সেই আগুনেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে সৃষ্টি হলো এই হ্রদের, বগাকাইন হ্রদ।’
নুজহাত আমার কথা বিশ্বাস করল কি না জানি না, সে আবার বগার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আর নিবে নাই–বা কেন। ঢাকা থেকে সারা রাত ধরে বাসযাত্রা শেষে বান্দরবানে এসে নামতে না–নামতেই তো আবার চান্দের গাড়িতে করে সোজা বগা লেক চলে এসেছি। ক্লান্তি বলেও তো একটা কথা আছে।
অবশ্য বগার পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকা এই ক্লান্তি দূর করার জন্য যথেষ্ট। শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের মাঝে এক টুকরা সবুজ পানির হ্রদ, নয়ন যে একদম জুড়িয়ে যায়। একটু পর আবার হাঁটা শুরু করতে হবে পাহাড়ি পথ ধরে, গন্তব্য ১৩ কিলোমিটার দূরের কেওক্রাডং।
সরকারি হিসাবে উচ্চতার দিক থেকে তাজিংডংয়ের পরেই কেওক্রাডংয়ের অবস্থান। যদিও বেসরকারি কিছু জরিপ বলে ভিন্নকথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাকা হাফং, কেওক্রাডংয়ের অবস্থান পঞ্চম। তাজিংডং সেরা দশেও নেই। তা যা-ই হোক, কেওক্রাডংয়ের বিশেষত্ব অন্য একটি জায়গায়। কেওক্রাডংয়ের চূড়া থেকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গগুলোর প্রায় প্রতিটিই দেখা যায়।
বগা লেকের পাড়ে ছোট্ট একটা পাহাড়ি পাড়া আছে, মূলত বম উপজাতির বাস। সেই পাড়াতে সিয়াম দিদি পর্যটকদের জন্য একটা কটেজ চালান। আমাদের গাইড রঞ্জনদা রুমা থেকে আগেই তাঁকে জানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর ওখানেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শহরের সঙ্গে তুলনা না করলে খাওয়ার আয়োজন বেশ রাজকীয় বলা চলে। জুমচাষ করা ভাত, কাঁচা আমের ভর্তা, পেঁয়াজ ভর্তা, পেঁপে ভর্তা, কুমড়ার তরকারি আর পাহাড়ি মুরগির ঝোল। বেশ ভরপুর একটা খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ জিরিয়ে কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।
সমতলে বাস করা মানুষ আমরা, পাহাড়ি পথে সামান্য একটু যেতেই হাঁপানো শুরু হয়ে গেল সবার। দলে মানুষ আমি বাদে আরও তিনজন। তিনজনের মধ্যে দুজন আবার প্রথমবারের মতো পাহাড়ে এসেছে। তাই বলে কি থেমে থাকা চলে? একটু পরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সবাই পানি নিয়ে নিয়েছিলাম সঙ্গে, কিন্তু সেই পানি শেষ হতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। গাইড রঞ্জনদার দিকে করুণ চোখে যখন তাকালাম, তিনি জানালেন সামনে একটা ঝিরি আছে। পানি ভরে নেওয়া যাবে সেখান থেকে।
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর দেখা পেলাম সেই ঝিরির। সুন্দর একটা নাম আছে এই ঝিরিটার, চিংড়ি ঝিরি। টলটলে স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে। মুখে তুলে নিতে মনে হলো অমৃত, পাহাড়ি ঝিরির পানি এমন মিষ্টি হয় কল্পনাও করতে পারিনি।
কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। যত এগোচ্ছি পথ তত খাড়া হয়ে আসছে। অবশ্য বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে যাওয়ায় নিজেদের খুনসুটির মধ্যে ক্লান্তি আর আগের মতো টের পাচ্ছি না। পা তার মতো এগিয়ে চলেছে আর আমরা আমাদের মতো গল্পে ব্যস্ত। এ ছাড়া পথের দুপাশের উপত্যকার সৌন্দর্য তো আছেই মন ভুলিয়ে রাখার জন্য।
প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার পর এসে হাজির হলাম দার্জিলিং পাড়ায়। এই প্রথম চোখের সামনে কেওক্রাডংয়ের আগমন ঘটল। দার্জিলিং পাড়া কেওক্রাডং শৃঙ্গের নিচে আরেকটি আদিবাসীদের গ্রাম। রঞ্জনদা ঠাট্টা করে বলে উঠলেন, ‘যদি কেওক্রাডং এভারেস্ট হয়ে থাকে তবে এই দার্জিলিং পাড়া তার বেসক্যাম্প।’
অল্প কিছু বসতি আর দুটো ছোট দোকান, এই নিয়ে দার্জিলিং পাড়া। চারপাশে সবুজ আর সবুজ, পাহাড়ের নিচে মেঘেরা খেলা করছে। সব মিলিয়ে অপরূপ এই গ্রাম। এখানকার এক স্থানীয় দোকানে চা খেয়ে আবার রওনা হলাম কেওক্রাডং চূড়ার উদ্দেশে।
এতক্ষণ তো অন্য পাহাড় ডিঙিয়ে কেওক্রাডংয়ের নিচে এসে হাজির হয়েছি, এবার উঠতে লাগলাম কেওক্রাডংয়ের গা বেয়ে। এবারের যাত্রাটুকু অবশ্য আগের চেয়ে অনেক কঠিন। জায়গায় জায়গায় ৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেছে পথ। সেই পথের চারপাশে উঁচু সবুজ ঘাস। অবশ্য এ পথের বিস্তার খুব বেশি নয়, দার্জিলিং পাড়া থেকে আধঘণ্টা হাঁটতেই হাজির হয়ে গেলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়।
কেওক্রাডং শব্দটি ‘মারমা’ ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় ‘কেও’ মানে পাথর, ‘কাড়া’ মানে পাহাড় এবং ‘ডং’ মানে সবচেয়ে উঁচু। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়।
কেওক্রাডং চূড়ায় সেনাবাহিনীর একটা ক্যাম্প আছে। সেখানে নিজেদের নাম এন্ট্রি করে চলে গেলাম হেলিপ্যাডে। সেনাক্যাম্পের রসদ সরবরাহ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে এই হেলিপ্যাড। সেখান থেকে চারপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
রাতে আশ্রয় নিলাম লালাদার কটেজে। গাইড রঞ্জনদা আগে থেকেই কটেজ ঠিক করে রেখেছিলেন। গোসল সেরে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম ঝটপট। আয়োজন সেই দুপুরের মতোই। এক দিন আগেও ঢাকায় ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরমে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পাহাড়ে যেন আজন্ম শীত। রাতে রীতিমতো শীতে কাঁপতে শুরু করে দিলাম। সারা দিনের ক্লান্তিতে সেই শীতের মাঝেই কম্বল মুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম হলো।
খুব ভোরে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর সে ভাগ্য আর কপালে সইল না। অবশ্য তাতে কোনো দুঃখ যে হচ্ছিল তা–ও নয়, বরং আনন্দ হচ্ছিল। চারপাশ যে মেঘে ছেয়ে গেছে একদম। দূর থেকে মেঘ তো সবাই দেখেছে, কিন্তু মেঘের একদম মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে কজন? সেই আনন্দে গুন গুন করে গেয়ে উঠলাম, মেঘের দেশে পাহাড়ে, আহা রে!
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান। বান্দরবান থেকে লোকাল বাসে কিংবা চান্দের গাড়ি/জিপ ভাড়া করে রুমা উপজেলা। বাসভাড়া ১১০ টাকা। জিপে রিজার্ভ ৩৫০০-৪০০০ টাকা নেবে।
রুমা বাজার থেকে যেখানেই যান, সঙ্গে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। রুমা বাজারে আরেকটা কাজ করতে হবে, আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে নিতে হবে। এ সময় পরিচয়পত্র দেখাতে হতে পারে।
রুমা থেকে জিপে বগা লেক। ভাড়া নেবে ১৮০০-২০০০ টাকা। বগা লেকে আরেকবার সেনাক্যাম্পে এন্ট্রি করে নিতে হবে। বগা লেক থেকে কেওক্রাডংয়ের এলিভেশন ডিফারেন্স ২০০০ ফুটের মতো, দূরত্ব ১৩ কিমি। সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে হেঁটে পৌঁছাতে।