বৃষ্টিমুখর হাওরে
কানশী নদী ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে ছুটে চলেছে আমাদের বাহন। তাহিরপুর ঘাট থেকে রওনা হওয়ার আগে নৌকায় বোঝাই করে নেওয়া হয়েছে দুই দিন হাওরবাসের প্রয়োজনীয় রসদ। ঘাটজুড়ে বেঁধে রাখা রংবেরঙের সারি সারি পর্যটক নৌকা মৃদু লয়ে দোল খায়। নৌকার ছাদের ওপর চেয়ার টেনে বসি।
পানিতে আলোড়ন তুলে দুই পাশে ঢেউ আছড়ে ফেলে ছুটে চলে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যেতে যেতে হাওর থেকে ফেরা নৌকা বিপরীতে ছুটে যায়। বালুবাহী বারকি নাও আর বাল্কহেড দেখে মনে হয়, এই বুঝি ডুবল! কিন্তু ঠিকই ভেসে থাকে পানির কিনার ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
নৌকা ছাড়ার সময়েই ঈশান কোণে কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়েছিল। হঠাৎই তাই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এল। যাত্রার শুরুতেই কাকভেজা হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নেই, তাই হুড়মুড়িয়ে নৌকার ভেতর ঢুকে পড়লাম। জানালার পাশে হেলান দিয়ে বসে দেখতে থাকি হাওরের অপূর্ব বৃষ্টি। স্থির পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গেই বলের মতো একদলা পানি লাফিয়ে উঠছে। তারপর ছোট্ট ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে চারপাশে প্রসারিত হয়ে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নৌকার পাশ কাটিয়ে পেছনে চলেছে জলার ঘাসবন, কলমিবনে বকের ইতিউতি চাহনি। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে আসা হাওরের হিমেল বাতাসের ছোঁয়া লাগছে চোখেমুখে। হাওরের ঘোর লাগা বৃষ্টি দেখতে দেখতে তন্দ্রা এসে ভর করেছিল, সংবিৎ ফিরে পেলাম সবার হাসির শব্দে।
দলের অন্যরা নৌকার ভেতর চক্রাকারে বসে কী একটা খেলছে আর আনন্দে ফেটে পড়ছে! ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। নৌকার ছাদে উঠে দাঁড়ালে দৃষ্টিজুড়ে ধরা দিল সীমাহীন অবাক জলের দুনিয়া! যত দূর চোখ যায়, ঢেউখেলানো নীল জলের রাজ্য। মাঝেমধ্যে সবুজ টিপের মতো জেগে থাকা হিজল-করচের বন। এ সৌন্দর্য ভাষাহীন! তারপর নাওয়ের আগায় গলুইয়ের ওপর বসলাম, পা দুখানা দুই পাশে ছড়িয়ে সাবধানে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি! অসাবধানতায় ভারসাম্য হারালে পড়ে যাওয়ার ভয়।
প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরের আয়তন ৬ হাজার ৯১২ একর হলেও বর্ষাকালে তা ২০ হাজার একর ছাড়িয়ে যায়। আমরা চলে এসেছি ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। নৌকা ভেড়ার পর সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারের চূড়ায় উঠে গেলাম। ওপর থেকে হাওর অন্য রকম রূপে ধরা দিল। আলোকচিত্রী সিদ্দিক টপাটপ ছবি তুলে চলেছেন। আমরা দুজন ছাড়া অন্য সবাই ছোট নৌকায় ধারেকাছে ঘুরতে বেরিয়েছে। পাশেই জলার বন। করচের ডালে বেণি করা চুলের মতো ঝুলে থাকা লতানো ফুল।
উদরপূর্তির জন্য দলনেতা রাফির ডাক পড়ল। পেট চোঁ চোঁ করছিল! তাই হাঁসের মাংসের সঙ্গে ডালভুনার স্বাদ মনে হলো অমৃতের চেয়ে বেশি কিছু!
ট্রলার আবার চলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর ছাদের ওপর উঠলাম। একসময় আবারও শুরু হলো বৃষ্টি। সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস। আকাশের এ অভিমান কখন থামে, কে জানে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় যায় অবস্থা। ছাদের ওপর তাই বেশিক্ষণ বসা গেল না। ভেতরে এসে বিছানায় আয়েশ করে আবার জানালার পাশে হেলান দিয়ে বসি।
সন্ধ্যা নামছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। আবছা নীলাভ রঙের মোলায়েম পরশ হাওরের বুকজুড়ে। ট্রলারের ঢেউয়ে হালকা দোল খেয়ে কখনো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ছোট জেলেনৌকা। চকিত হয়ে হিজল-করচের বন থেকে ডানা ঝাপটে সরে যাচ্ছে দু-একটা বক-পানকৌড়ি। হাওরের সীমারেখায় মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে জ্বলছে সারি সারি সীমান্তবাতি। দূরে হাওর পেরিয়ে পাহাড়শ্রেণির চূড়ায় ঘোঁট পাকিয়েছে জমাট বাঁধা মেঘদল। নৌকার চলার পথে সামনে পড়ল এক হাওর গ্রাম। ভাসছে হাওরের ওপর যেন দ্বীপের মতো। এই গ্রামের নাম গোলাবাড়ি। দূরে হাওরের এক প্রান্ত দেখিয়ে দলের রাফি বলল, লাকমা ছড়া আছে ওই দিকে।
নৌকা টেকেরঘাটে ভেড়ার সময় একদম অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যার পর আবহাওয়া মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে এল। ছাদের ওপর সবাই মিলে তাই অনেক রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা-গান-গল্পবাজি। একসময় ঘুমোতে গেলাম। জানালার একদম পাশে শুয়েছিলাম, ফলে বন্ধ জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া কনকনে বাতাস বুকে কাঁপন ধরায়।
রাতের শেষ প্রহরের আবছা আঁধার তখনো কেটে যায়নি, ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ-ওপাশ করে নৌকার ভেতর থেকে বের হয়ে এলাম ছাদের ওপর। আধবোজা চোখ কচলাতে কচলাতে অবাক হয়ে দেখি, অপার্থিব নীলচে আলোয় ভাসছে যেন পুরো হাওর। আবছা আঁধার ফুঁড়ে সে নীলের মোলায়েম চাদরে জড়িয়ে আছে আকাশ জমিন হাওর তেপান্তর!
আলো আরেকটু ফোটার পর আমরা তিন-চারজন হাঁটতে বের হলাম। হাওরের প্রান্ত ছুঁয়ে নীলাদ্রি হ্রদ। হ্রদের গা ছুঁয়ে মেঘালয় পাহাড়ের চূড়ায় ক্রমে উঠে গেছে চুনাপাথর আর শৈলশ্রেণির দেয়াল। পাহাড়ের গা যেন জড়িয়ে ধরে আটকে থাকা বাড়িঘরের সীমা ছাড়িয়ে পাহাড়শ্রেণির চূড়ায় জমেছে মেঘ, তার ছায়ায় লেকের নীল জল। মেঘকণা আর ভোরের বাতাসের হিম পরশ গায়ে মেখে নৌকায় ফিরে আসি। নাশতার পর মাঝি নোঙর তুলল। তারপর হাওরে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল পুরো সকাল। ফেরার পথে নৌকা থামিয়ে গোসলে নামলাম। টাঙ্গুয়ায় এসে গোসল না করেই ফিরে যাব, তা–ই কি হয়! সাঁতার আর দাপাদাপির মধ্যে অজান্তেই কেটে গেল অনেকটা সময়। উঠে শুকনা কাপড় পরতে না পরতেই লাঞ্চের ডাক পড়ল। খেয়েদেয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসি জানালার পাশে। হাওরের বিশালতা, জলরাশি পেছনে রেখে নৌকা ঘাটে ভেড়ার সময় আকাশ তখনো মেঘে ঘনঘোর।
যাবেন যেভাবে
টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় যেতে হবে। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ বাসে, সেখান থেকে তাহিরপুর যাওয়ার বাস বা লেগুনা পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে ট্রেন বা উড়োজাহাজে সিলেট পর্যন্ত এসে বাকি পথটুকু বাসেও আসা যায়। তাহিরপুর নদীর ঘাটে পর্যটক নৌকা রয়েছে। সেসব নৌকা ভাড়া করেই যেতে হবে হাওরে। তবে ভালো হয় আগেই নৌকা বুকিং করে যেতে পারলে।