তিন সাগরের রানি কন্যাকুমারী
বছর দুয়েক আগে কাশ্মীর আর লাদাখ ঘুরে আসার পর থেকেই একটা সুপ্ত ইচ্ছা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল—ভারতের উত্তর প্রান্ত তো ঘুরে দেখা হলো বেশ ভালোভাবে, এবার দক্ষিণ প্রান্ত। কারণ, শিমলা-মানালি, উত্তরাখণ্ডের নৈনিতাল-মুশৌরি-গঙ্গোত্রীসহ উত্তরের নানা জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দক্ষিণ অদর্শনে অতৃপ্ত থাকব কেন? যদিও একবার ভারতের দক্ষিণে গোয়া-কেরালা যাওয়া হয়েছে, কিন্তু একদম দক্ষিণের বিন্দু কন্যাকুমারী দেখার বড় ইচ্ছা ছিল মনে মনে।
তিনটি কারণে কন্যাকুমারী দেখার তীব্র ইচ্ছা মনের মধ্যে। এক. এটি ভারতের শেষ বিন্দু বা মূল ভূখণ্ডের শেষ প্রান্ত। দুই. এখানে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর আর ভারত মহাসাগরের মহামিলনে নীল জলরাশির এক রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ থাকে সব সময়। তিন. এখানে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম চিন্তাবিদ এবং গুরু স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত ‘বিবেকানন্দ রক’। মনে হলো বাঙালির স্মৃতিধন্য নীল জলরাশিতে ডুবসাঁতার কাটার আনন্দে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না।
হুট করে এই ঈদের ছুটিতে পারিবারিক প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়েছিল চেন্নাইয়ে। তখন থেকেই কন্যাকুমারী দর্শনের তীব্র ইচ্ছা মনে জেগেছিল। তিন দিনের বিরতি পেয়েই ঝটপট ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে গেলাম চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে। কিন্তু মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত ভারতীয় ট্রেনের ততোধিক জটিল নিয়মকানুনের জন্য টিকিট পাওয়া গেল না।
কিন্তু ওই যে গোঁ, সেটি আর থামানো গেল না! শেষ চেষ্টা হিসেবে চলে গেলাম চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের কোইমবেটু বাসস্ট্যান্ডে। চেন্নাই থেকে দূরপাল্লার সব সরকারি আর বেসরকারি বাস এ স্ট্যান্ড থেকেই ছেড়ে যায়।
বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে সরকারি ননএসি বাসের টিকিট পেয়ে গেলাম। টিকিট করে ঝটপট হোটেলে ফিরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চেন্নাই থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরের কন্যাকুমারী যাওয়ার ননএসি বাসের উদ্দেশে। মনে মনে কিছুটা ভয়, শঙ্কা ছিল ঠিকই। কারণ, একটানা এত লম্বা বাসভ্রমণ এর আগে কখনোই করা হয়নি। দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টার ননএসি বাস জার্নি, তাও জুনের এই ভয়াবহ গরমে! শেষ পর্যন্ত মনে অদম্য সাহস নিয়ে উঠেই পড়লাম বাসে। গরমে, ঘামে, জ্যামে, ঝিরঝিরে বাতাসে, আঁধার রাতে কত যে অচেনা শহর-বন্দর-গ্রামের পথ পেরিয়ে, পথের মাঝে তিন থেকে চারটি বিরতি দিয়ে বেলা ১১টায় পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই ছোট্ট শহরে, দুই সাগর আর এক মহাসাগর—তিন বিশাল জলরাশির মহামিলনস্থল স্বপ্নের সেই কন্যাকুমারীতে।
বাস যখন কন্যাকুমারীর শেষ পথে চলতে শুরু করেছিল তখন থেকেই সমুদ্র সমুদ্র একটা পুলক অনুভব করছিলাম চারপাশের প্রকৃতি দেখে। পথের দুধারে সারি সারি নারকেলগাছ, সামুদ্রিক বাতাসে যারা সারাক্ষণ নেচে বেড়াচ্ছে আপন মনে, মাতাল বাতাসে। উইন্ড মিলের বিশাল বিশাল পাখাগুলো জানিয়ে দিচ্ছিল কাছেই মহাসমুদ্রের মহামিলন। হু হু বাতাসের তোড়ে শেষ পথটুকু বাস যেন উড়ে উড়ে চলছিল! বাস থেকে নেমে, একটি মনের মতো হোটেল খুঁজে সেখানে ব্যাগপত্র রেখে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম দীর্ঘতম বাসভ্রমণের ধকল কাটিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে।
উত্তাল নীল জলরাশি, মহাসমুদ্রের মহামিলন, কয়েক মানুষের চেয়েও উঁচু উঁচু ঢেউয়ের আছড়ে পড়া, সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বিবেকানন্দ রক, নতুন গড়ে ওঠা বিশাল মূর্তি, মহাসাগরের মাঝে ঢেউয়ের দোলায় ভেসে চলা রঙিন বোট, মাছ ধরার ট্রলার, শত মানুষের ভিড়, ঝকঝকে আকাশে সাদা মেঘেদের উড়ে যাওয়া, চারপাশে সবুজের নাচন, উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মাতাল বাতাস—সবকিছুই উপভোগ করা যাচ্ছিল আমার রুমের কাচের জানালা দিয়ে। কোনো সরাইখানার এমন অপূর্ব, অপার্থিব আর মোহময় কক্ষে এই জীবনে খুব কমই থেকেছি। ইচ্ছে হচ্ছিল রুমের উন্মুক্ত বেলকনিতে বসে কাটিয়ে দিই এ বেলাটুকু। কিন্তু মন তখন দুভাগে বিভক্ত। একটা মন চাইছে মহাসাগর থেকে আসা ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে মেখে বেলকনিতে বসে নীল জলরাশি দেখতে দেখতে অলস সময় কাটাতে, আর মনের অন্য অংশ চাইছে একছুটে শেষ বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়িয়ে মহাসাগরের মহামিলন দেখতে। তর্কযুদ্ধে জয় হলো বাঙালি জেদের।
একদম নতুন কাপড় পরে পথ ধরলাম অনেক দিনের লালিত স্বপ্নের সীমানা ছুঁতে—কন্যাকুমারীর শেষ বিন্দু, ভারতের শেষ ভূখণ্ড স্পর্শ করে, মহাসমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মহামিলনে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে স্বপ্ন পূরণের শিহরণে পুলকিত হতে।
আমার হোটেল থেকে কন্যাকুমারীর শেষ বিন্দুতে যেতে সময় লাগল প্রায় ১০ মিনিট। কারণ অনেকটা পথ পেরিয়ে, ঘুরে ঘুরে যেতে হয় সেখানে। তখন বিকেল গড়িয়ে পড়ছে কন্যাকুমারীর নীল জলে। শেষ বিকেলের মায়াময় আলো গায়ে মেখে কন্যাকুমারীর শেষ বিন্দুতে, বিশাল বিশাল পাথরে ঘিরে রাখা প্রাচীরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে বড় বিস্ময়কর অনুভূতি। এখানে, এই মহাসমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মধ্যে অনন্তকাল ধরে দুটি দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিস্ময়কর পাথরখণ্ডের একটিতে বসে একদিন ধ্যান করেছিলেন বিবেকানন্দ নামের এক বাঙালি! ঝোড়ো বাতাসে উড়ে যেতে ইচ্ছে করাই তখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। আমি দাঁড়িয়ে থাকি শেষ বিকেলের নরম আলো গায়ে মেখে। আমাকে ছুঁয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক নোনা বাতাস। আমি তখন স্বামীজিকে খুঁজে ফিরি সেই বিস্ময় পাথরের ওপরে গড়ে তোলা বিবেকানন্দ মেমোরিয়ালের উপাসনালয়ে, লাইব্রেরিতে, ধর্মীয় আচারের নানা রকম আয়োজনে। ধীরলয়ে অস্তাচলে যায় দিনমণি। আমাকে ফিরতে হয় সরাইখানায়।
কন্যাকুমারী তামিলনাড়ু রাজ্যের নাগোড়কৈল জেলার একটি ছোট্ট শহর। মহাসমুদ্রের তীর ঘেঁষে এখানে রয়েছে অনেক হোটেল, মোটেল, পর্যটনকেন্দ্র, বাসস্ট্যান্ড, ভীষণ নান্দনিক একটি রেলওয়ে স্টেশন। আর রয়েছে নানা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসের সম্ভার পুরো কন্যাকুমারীর উপকূল ঘিরে। মাছ, ডাব, নানা রকম সামুদ্রিক খাবারসহ, দেশি–বিদেশি পর্যটকদের জন্য সব রকমের খাবার আর বিনোদনের সব আয়োজন আছে এখানে। ৫০০ থেকে ১৫ হাজার রুপিতে প্রতিদিন থাকতে পারবেন যেকেউ।
কন্যাকুমারী যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে প্লেনে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের সর্বশেষ বিমানবন্দর ত্রিভুন্নাপুরামে উড়ে যাওয়া। যেখান থেকে কন্যাকুমারী পথের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এরপরের উপায় হলো কলকাতা থেকে কন্যাকুমারী ট্রেন। সাপ্তাহিক দুটি ট্রেন ছাড়ে কলকাতা থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। সময় লাগে ৪২ থেকে ৪৫ ঘণ্টা। এ ছাড়া চেন্নাই হয়েও কম সময়ে ট্রেন আর বাসে করে যাওয়া যায় কন্যাকুমারী। ভ্রমণপিপাসুদের একবার হলেও ঘুরে আসা উচিত ভারতের দক্ষিণের শেষ প্রান্ত কন্যাকুমারী থেকে।
ছবি: লেখক