কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা এই বাক্য আরেকবার মনে হলো দুধপাথরি এসে। আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণের পাঁচ দিনের শেষ গন্তব্য ছিল সেটা। যখন হোটেলমালিক মুজাফফরকে বললাম দুধপাথরি যেতে চাই, উনি সানন্দে রাজি হলেন। আগের রাতে আমরা শ্রীনগর চলে এসেছি।
উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে
গুগল ম্যাপসে দেখলাম ৪৬ কিলোমিটার পথ। ভাবলাম ঘণ্টা দেড়েক লাগবে, কিন্তু দেড় ঘণ্টা সমতল আর টিলার মতো রাস্তায় চলার পর দেখলাম আরও ২২ কিলোমিটার বাকি। হঠাৎ করে গাড়ি উঁচুতে উঠতে শুরু করল, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা, বুঝলাম পাহাড়ি এলাকা শুরু হচ্ছে। কাশ্মীরের রাস্তায় এমনিতেই জনমানব কম দেখা যায়, আর এই রাস্তায় আরও কম, দুই পাশে আপেলের বাগান। এই এলাকার আপেলগাছগুলো আকারে ছোট কিন্তু গাছভর্তি লাল রঙের আপেল, ফলের কারণে গাছের পাতাই দেখা যায় না।
আধা ঘণ্টা এভাবে চলার পর একটি রেস্তোরাঁয় কয়েকটি ট্যুরিস্ট গাড়ি দেখে আমরাও নামলাম, রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে শুনলাম বছরের বেশির ভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে এই জায়গা। যদিও গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে আমরা সেটা পাইনি। রেস্তোরাঁয় এগ রোল আর মসলা চা খেয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম, এবার আরও উঁচুতে। রাস্তার দুই পাশে লম্বা লম্বা পাইন আর দেবদারুগাছের সারি।
আবহাওয়ার সঙ্গে প্রকৃতির বদল
গাড়ি থেকে নেমে আমরা অবাক। মনে হচ্ছিল আগের দিন ঘুরে আসা ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত পাহেলগামের বাইসারান ভ্যালির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কাশ্মীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র এই বাইসারান ভ্যালি শ্রীনগর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অনন্তনাগ জেলার পাহেলগামের মধ্যে। বলে রাখা ভালো, বাইসারান যেতে অবশ্যই ঘোড়ায় চড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও কারও কারও জন্য ভীতিকরও বটে। অন্যদিকে দুধপাথরি ভ্যালিতে ফোর হুইল ড্রাইভ বা সেডান গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। আর পর্যটনকেন্দ্রেই সরাসরি গাড়ি থেকে নামতে পারবেন। বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা, দূরে সারি সারি পাইনগাছ, আরও দূরে সুউচ্চ পাহাড়ে মেঘের খেলা এক অন্য জগতের অনুভূতি এনে দেবে। এখানে প্রতিটা জায়গাই যেন একেকটি ট্যুরিস্ট স্পট, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির ভিন্ন রূপে।
দুধের মতো সাদা পানি
দুধপাথরি হিমালয় পর্বতমালার পীর পাঞ্জাল রেঞ্জে গামলার মতো এক উপত্যকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট উঁচুতে জম্মু ও কাশ্মীরের বুডগাম জেলায় অবস্থিত। দুধপাথরি নামের অর্থ দুধের উপত্যকা, এর সঙ্গে কাশ্মীরের বিখ্যাত মুসলিম সাধক শাইখ উল আলম শেখ নূর-উদ-দিন নূরানীর নাম জড়িয়ে আছে। এখানে যে পানি প্রবাহিত হয়, তা দূর থেকে দেখলে দুধের মতো সাদা মনে হয়। পানি সারা বছরই হিমশীতল থাকে। বড় বড় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে এই পানি দেখতে হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসই ভালো। কারণ বছরের অন্য সময়ের বেশির ভাগই থাকে বরফ। সে জন্য যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়।
প্রায় ঘণ্টা দুই ইচ্ছেমতো সময় কাটিয়ে ঠান্ডা পানির ঝাপটা আর অস্থায়ী দোকান থেকে পেটপুরে খাবার খেয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। বিকেলের রোদে সকালে দেখা পাহাড়গুলো অন্য রকম লাগছিল। মন চাইছিল ফেরার পথে আরও কয়েক জায়গায় থামি। কিন্তু সন্ধ্যার আগে শ্রীনগর ফেরার তাড়া থাকায় সেটা আর সম্ভব হলো না। অসাধারণ কিছু স্মৃতি নিয়ে শেষ হলো আমাদের দুধপাথরি দর্শন।