বাড্ডায় বিশাল রান্নাঘরে শত শত লোকের রান্না
৭৫ হাজার বর্গফুটের রান্নাঘরে কয়েক শ রাঁধুনি রাত তিনটা থেকে রান্না শুরু করেন। তাঁদের রান্না করা খাবার রাজধানীর গুলশান, বনানী, পল্টন, মতিঝিলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে পৌঁছে যায় দুপুরের মধ্যে। শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষেরা নিজের আসনে বসেই খাচ্ছেন দুপুরের গরম-গরম খাবার। মেন্যুতে ভাত, ডাল, দেশি মুরগি, মাছ, সবজি। এর জন্য খরচ পড়ে গড়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা । কেউ চাইলে খাবারের তালিকা আরও কিছুটা লম্বা করতে পারেন, তার জন্য বাড়তি টাকা দিতে হয়।
রাজধানীর বাড্ডার বেরাইদে ১৫ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিশাল রান্নাঘর। নাম খান’স কিচেন। রান্নাঘরের হাঁড়িপাতিলসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে জার্মান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। এখানে রাইস স্টিমারে একসঙ্গে রান্না করা যায় ৩৮০ কেজি চালের ভাত। অত্যাধুনিক হাঁড়িতে একসঙ্গে রান্না হয় ৩০ থেকে ৪০ কেজি ডাল। আর একবার স্যুপ রান্না করলে তা ৩০০ থেকে ৪০০ লোক খেতে পারে। ওভেনে একসঙ্গে ৫০০ খাবারের প্যাকেট গরম করা যায়। একবার এ রান্নাঘরে একসঙ্গে ৩০ হাজার লোকের রান্না হয়েছিল। তবে এক লাখ মানুষের জন্য এ রান্নাঘরে রান্না করা সম্ভব।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান টাইম বক্স’-এ করে খান’স কিচেনের নিজস্ব গাড়িতে করে খাবার পাঠানো হয়। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে খান’স কিচেনের গাড়িতে খাবারের সঙ্গে কর্মীদের পাঠানো হয়। কর্মীরা ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে খাবার পরিবেশন করেন। তিন শর বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী এখানে নিয়মিত কাজ করেন। বড় আয়োজনের সময় বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়।
এই খান’স কিচেন গড়ে তুলেছেন নারী উদ্যোক্তা আফরোজা খান। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তিনি। তাঁর স্বামী আলিফ আহমেদ খান রান্নাঘরের জন্য জমি দিয়েছেন এবং প্রয়োজনে সব ধরনের সহায়তা করছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক পার্টনার ও চেয়ারম্যান শেফ টনি খান। টনি খানের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে রান্নাঘরের কার্যক্রম।
২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করেছিল এ রান্নাঘর। টনি খান প্রথম আলোকে বলেন, রান্নাঘর হিসেবে এটি দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়। কর্মজীবী মানুষের জন্য গরম খাবার পৌঁছে দেওয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি খান’স কিচেন বিভিন্ন এয়ার লাইনসে খাবার পরিবেশনের কথা চিন্তা করছে।
চাইলেই এই রান্নাঘরে ঢোকা যায় না। নানা বিধি-বিধান মেনে ঢুকতে হয়। সম্প্রতি এই প্রদিবেদকও সব প্রক্রিয়া মেনে এই রান্নাঘরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন।
রান্নাঘরে ঢোকার আগে কয়েকটি ধাপ পার হতে হয় কর্মীদের। পোশাক পাল্টানোর জন্য আছে আলাদা কক্ষ। পোশাক গায়ে দিয়ে হাত ধুয়ে কর্মীদের ঢুকতে হয় একটি বিশেষ লিফটে। তাতে কর্মীর শরীর জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা আছে। তারপর কর্মীরা নিজ নিজ কক্ষে ঢুকে যান। এক এক ধরনের পোশাক গায়ে দেওয়া কর্মীর জন্য পৃথক পৃথক কক্ষ। এক কক্ষের কর্মীর অন্য কক্ষে ঢোকার নিয়ম নেই। তেমনিভাবে যে কক্ষে মাংস কাটাকুটি করা হয়, সেখানে মাছের প্রবেশ নিষেধ। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মেনেই চলে রান্নার কাজ। সবজি ধোয়া, কাটাসহ বিভিন্ন কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে খাবারে কর্মীর হাতের ছোঁয়া লাগছে খুব কম।
রান্না শেষে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ। যথাযথভাবে তা প্যাকেট করে খান’স কিচেনের নিজস্ব পরিবহনে তা তুলে দেওয়া হয়। এরপর রান্নাঘর পরিষ্কারের পালা। বড় ডিশ, প্লেট ধোয়ার জন্য আছে আলাদা মেশিন। খাবারে সবকিছু ঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য আছে নিজস্ব ল্যাবরেটরি। আর মাঠপর্যায় থেকে সবজি, মাছসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সরাসরি সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। পচা, বাসি সবজি রান্নাঘরে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই।
আফরোজা খানের ২০ বছরের বিবাহিত জীবন। তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে। গাজীপুরের মেয়ে আফরোজা খান ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এইচএসসিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয় তাঁর। স্বামীর বাড়ি ঢাকায়। রান্নাঘরের যাত্রা শুরুর আগে কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এ দম্পতি।
আফরোজা খানের সকাল শুরু হয় ভোর বেলায়। খান’স কিচেনের কাছেই বাচ্চাদের স্কুল। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আফরোজা ঢুকে যান রান্নাঘরে। রান্নাসহ যাবতীয় বিষয়ে তদারকি করে বেলা তিনটার দিকে স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় ফেরেন। খাবারের বাড়তি অর্ডার থাকলে বাচ্চাদের বাসায় নামিয়ে আবার আসেন রান্নাঘরে।
রান্নাঘরের কর্মযজ্ঞ এবং সময়মতো দুপুরের খাবার পরিবেশনসহ বিভিন্ন গুণাবলির জন্য আফরোজা খান পেয়েছেন বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘প্রতিভাবান সম্মাননা ২০১৭’।