কাশ্মীর সামলাতে পারবেন মোদি?
সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল করে দিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার। নিন্দুকেরা বলছেন, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে জনমিতিসংক্রান্ত পরিবর্তন আনতে চাইছে বিজেপি। মোদি নিজে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কিন্তু মোদির প্রত্যাশার সম্পূর্ণ উল্টোটা হওয়ার আশঙ্কাও আছে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরপরই কাশ্মীরে প্রথম ভাঙন দেখা দেয়। পুরো অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ভারত। এর পরিবর্তে জম্মু-কাশ্মীরকে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। সেই হিসাবেই জম্মু-কাশ্মীরের ছিল আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা। এই অঞ্চলে যাতে জনমিতি–সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন না হতে পারে, সেই জন্যই কাশ্মীরের অনাবাসিক ভারতীয়রা সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। তবে গত ৫ আগস্ট এক আইনে জম্মু-কাশ্মীরের সব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রদ করে দিয়েছে মোদি সরকার। একই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এর রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চল এখন সরাসরি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদিকে ‘পোস্টার বয়’ বানিয়ে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তবে শরিকদের কারণে ওই মেয়াদে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের দাবি এতটা জোরেশোরে ওঠেনি। তবে চলতি বছরের ভোটযুদ্ধে কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধীদের স্রেফ ধুয়েমুছে সাফ করে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। আর ক্ষমতায় আসার মাসখানেকের মধ্যেই নিজেদের পুরোনো অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে ফেলল মোদির সরকার। সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার পথ ছিল দুটি—হয় পার্লামেন্ট নতুবা রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে। এ জন্য পার্লামেন্টে বিজেপির প্রয়োজন ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেটি পুরোপুরি না থাকায় মোদির সরকার বেছে নিল দ্বিতীয় পথটি। দিন শেষে সেই পথে কাজও হয়েছে। মোদি বলছেন, জম্মু-কাশ্মীরের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন ভারতবিরোধী সহিংসতা সৃষ্টির প্রধান কারণ। সাংবিধানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই সহিংসতা কমিয়ে আনা যাবে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর সন্দেহাতীতভাবেই সংঘাতপ্রবণ এলাকা। জম্মু-কাশ্মীরের প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অনেক দিন ধরেই দমনমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। একটু সংখ্যার দিকে তাকাই। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য সরকারকে ৯৫ বার বরখাস্ত করেছিল। কংগ্রেসের আমলে হয়তো এমন নীতিতে কিছুটা রাখঢাক থাকে। কিন্তু বিজেপির আমলে সংগত কারণেই দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ্য। আর এ কারণেই আশঙ্কা করা হচ্ছে, কাশ্মীরে জ্বলে উঠতে পারে বিক্ষোভের দাবানল। এর কিছু আলামত এরই মধ্যে দেখাও দিয়েছে, ছোট আকারে শুরু হয়ে গেছে সংঘর্ষ। সেখানকার তরুণ ও শিক্ষিত সম্প্রদায় এরই মধ্যে ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে।
সরকার ও বিজেপির তরফে বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণই নাকি লাভবান হবে। তবে বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে যাঁর ন্যূনতম ধারণাও আছে, তিনিও এই আশ্বাসে আস্থা রাখবেন বলে মনে হয় না। হাফিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদ করার ক্ষেত্রেও সেই ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ নীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। ঘোষণা আসার আগ থেকেই ওই অঞ্চলে মোতায়েন করা হয় ৩০ হাজার সেনা। ঘোষণার পর পাঠানো হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর আরও ৮ হাজার সদস্য। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের। এভাবে জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াতেই বিপদ দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ কাশ্মীরিরা আইন অমান্য ও সহিংস কর্মকাণ্ডে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়তে পারে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই এভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত মানতে কাশ্মীরিদের বাধ্য করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এতে ভারত সরকারের ওপর কাশ্মীরিদের অনাস্থা আরও বাড়বে। আগে থেকেই ভোটযুদ্ধে কাশ্মীরিদের আগ্রহ কম। এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে পুরো ভারতের গড় ভোটার উপস্থিতি ৬২ শতাংশ, সেখানে কাশ্মীরে তা ৩০ শতাংশের কম। আর রাজধানী শ্রীনগরে তা নেমেছে ১৪ শতাংশে। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের পর এই সংখ্যা যে আরও কমে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ–কাশ্মীরি ভারতীয়রা কাশ্মীরে সম্পত্তি কেনার অনুমতি পেলে, মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলটির জনমিতিতে পরিবর্তন আসবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা জম্মু-কাশ্মীরে সম্পদ কিনতে গেলে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তা থেকে সংঘাত ছড়িয়ে পড়াও অসম্ভব নয়।
কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা ১৯৮৭ সালের দিকে। ওই সময় স্থানীয় নির্বাচনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের সূচনা হয়। এ ধরনের সশস্ত্র আন্দোলনের পেছনে পাকিস্তানের ‘উৎসাহ’ ছিল বলে সব সময় ভারত অভিযোগ করে আসছে। মোদির সরকার সম্প্রতি যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে পাকিস্তানের জন্য সুবিধা হয়েছে। এখন কাশ্মীরিদের বিভিন্ন উগ্রপন্থী গ্রুপে ভেড়ানো আরও সহজ হয়ে যাবে। এতে করে ওই এলাকায় ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির সম্ভাবনাও প্রবল।
অথচ বাস্তবিক অর্থে, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা দীর্ঘদিন ধরেই পুরোপুরি মানা হচ্ছিল না। বিবিসি বলছে, জম্মু-কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান ও পতাকা থাকলেও এই অঞ্চল অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা পেত, তা বলা যাবে না। বিশেষ মর্যাদার বেশির ভাগই ছিল কাগজে-কলমে। তবে কাশ্মীরিদের কাছে এর প্রতীকী ও প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব অনেক। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত করেছে মোদির সরকার। ফলে ওই অঞ্চলে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
২০১৪ সালে সরকার গঠনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তিনি এমন একটি ফেডারেল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চান, যেটি সহযোগিতামূলক হবে, জবরদস্তি নয়। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই কথারই বরখেলাপ করলেন মোদি। গুজরাটের এই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সব সময় ‘সাহসী’ ও চমকজাগানিয়া পদক্ষেপ নিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে চান, তা কাজে দিক আর না দিক। নোট বাতিল বা জিএসটি চালুর মতো সিদ্ধান্তেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। এবার জম্মু-কাশ্মীর দুই টুকরো করে মূলত হিংসাত্মক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় বিভেদের পথেই দৌড়ানো শুরু করলেন মোদি। এটি আর যা–ই হোক, ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।