আমেরিকার ওপর চীন 'বদলা' নেবে কীভাবে?
হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীনকে আটকাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে হুয়াওয়ে। কিন্তু চীন কি চুপ করেই থাকবে? বিশ্লেষকেরা বলছেন, চাইলে চীনও থামিয়ে দিতে পারে আমেরিকার লম্ফঝম্ফ। কারণ শুধু অ্যাপল নয়, আরও অনেক মার্কিন কোম্পানিই চীনের ওপর নির্ভর করে মুনাফা গুনছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে অ্যাপল নিয়ে। বলা হচ্ছে, হুয়াওয়ের বদলা অ্যাপল দিয়ে নিতে পারে চীন। কারণ পণ্য উৎপাদন, সাপ্লাই চেইন ও ভোক্তা বাজার বিবেচনায় চীনের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল অ্যাপল। এরই মধ্যে চীনে অ্যাপলের পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমেও গেছে। এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে চীনে ৩৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রি করেছিল অ্যাপল। সেখানে ২০১৯ সালে তা কমে হতে পারে ২৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইউনিট। অর্থাৎ একদিক থেকে এখনই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অ্যাপল।
তবে শুধু অ্যাপল নয়, আরও অনেক মার্কিন কোম্পানিই চীনের ঘাড়ে সওয়ার হয়েই লাভের অঙ্ক বাড়াচ্ছে। সি চিন পিংয়ের সরকার যদি এগুলোর প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে, তবে পুরো মার্কিন অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভোক্তা বাজার হিসেবে চীন বিশ্বে অন্যতম প্রধান। এর বাইরে আছে সস্তা শ্রমের প্রলোভন। তাই এত দিন চীনই ছিল বিনিয়োগকারীদের প্রধান গন্তব্য। এই চিত্রে পরিবর্তন এলে তা যুক্তরাষ্ট্রকেও ছেড়ে কথা বলবে না।
হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গেভকাল রিসার্চ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ভালো সুযোগই আছে চীনের। এর মধ্যে আছে—বিরল ধাতুর রপ্তানি নিষিদ্ধ করা, চীনে কাজ করা মার্কিন নির্বাহীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা, চীনা মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন, জ্বালানির বৈশ্বিক দর বাড়াতে কৌশল গ্রহণ প্রভৃতি। এ ছাড়া মার্কিন নাগরিকদের চীন ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে চীন।
আসুন জেনে নেওয়া যাক, আমেরিকার ওপর কোন কোন ক্ষেত্রে ‘বদলা’ নিতে পারে চীন:
বিরল ধাতু: এই একটি খাতে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে চীন। বিরল ধাতুর বৈশ্বিক উৎপাদনের ৯০ শতাংশই হয় চীনে। আমেরিকাও বেশির ভাগ বিরল ধাতু সংগ্রহ করে চীন থেকে। চাইলে বিরল ধাতুর সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে চীন। সে ক্ষেত্রে মার্কিন মুলুকের সিলিকন ভ্যালির উৎপাদন থমকে যাবে, নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামরিক উৎপাদনেও। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, ভারত, ব্রাজিল ও থাইল্যান্ড থেকেও বিরল ধাতু সংগ্রহ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কা অনুভূত হবেই। আর অন্যান্য উৎস থেকে বিরল ধাতু পাওয়া গেলেও, তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট হবে কিনা—তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
হোটেল: চীনে অনেক মার্কিন কোম্পানি হোটেল তৈরিতে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। যেমন: চলতি বছরেই চীনে ৩০টির বেশি হোটেল খোলার পরিকল্পনা করেছে ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেশন। সব মিলিয়ে পুরো চীনজুড়ে তিন শরও বেশি হোটেল চালাতে চায় ম্যারিয়ট। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় থাকা ম্যারিয়টের মোট প্রকল্পের অর্ধেকই চীনে। ম্যারিয়ট বাদেও চীনে হোটেল ব্যবসায় আছে মেরিল্যান্ডভিত্তিক হোটেল কোম্পানি বেথেসদা। চীন যদি ব্যবসার নিয়মকানুন কঠোর করে তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব প্রতিষ্ঠান।
উড়োজাহাজ: চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। উড়োজাহাজ ব্যবসায় চীনে বেশ এগিয়ে আছে মার্কিন কোম্পানি বোয়িং। যদি সি চিন পিংয়ের সরকার বোয়িংয়ের প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তবে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এর প্রভাব পড়বে মার্কিন অর্থনীতিতেও।
জুতা: এই খাতে চীনে দুর্দান্ত অবস্থানে আছে নাইকি। এই কোম্পানি সাংহাই ম্যারাথন ও চীনের শীর্ষস্থানীয় সকার লীগের স্পনসর। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে নাইকির রাজস্ব আয় ২৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নাইকির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছে চীনা কিছু প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাইকির ওপর নাখোশ হতে পারে চীনারা। সে ক্ষেত্রে অ্যাপলের মতো ভুগতে পারে নাইকি।
চলচ্চিত্র: ক্যাপটেন আমেরিকা বা আয়রনম্যানের মতো অ্যাভেঞ্জার্সদের সিনেমা চীনে ব্যাপক চলে। বেইজিংসহ চীনের বিভিন্ন এলাকার সিনেমা হলে এসব হলিউডি ছবি প্রদর্শিত হয়। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অ্যাভেঞ্জার্স:এন্ডগেম’ ছবির সৌজন্যে চীনে টিকিট বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের। গেম, টিভি শো ও অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য ওয়াল্ট ডিজনির মতো হলিউডি প্রতিষ্ঠান বেইজিংভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বাঁধছে। চীনের বাজার আরও ভালোভাবে ধরতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন ডিজনির। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার রেষারেষি তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এরই মধ্যে চীনে হলিউডি সিনেমার মুক্তি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে সি চিন পিংয়ের সরকার। এর বিপরীতে দেশীয় বিনিয়োগে তৈরি জাতীয়তাবাদী ছবিকে উৎসাহ দিচ্ছে চীন। এসব বিধি-নিষেধ আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গাড়ি: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ির বাজার। মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কাছে তাই চীনের বাজার অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরই মধ্যে চীনে চাপে পড়ে গেছে মার্কিন কোম্পানিগুলো। গত ১২ মাসে চীনে মার্কিন গাড়ির বিক্রি ২৮ শতাংশ কমেছে। জেনারেল মোটরস কোম্পানি চীনে বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। অথচ গত বছরের তুলনায় এই কোম্পানির আয় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে গেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ যদি চীনা ভোক্তারা নিজেদের মানিব্যাগ দিয়ে আমেরিকার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়, তবে বেশ বিপদে পড়ে যাবে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন কোম্পানিগুলো। আর যদি চীনা সরকারও তাতে সুর মেলায়, তবে তো কথাই নেই। অবশ্য সে ক্ষেত্রে চীনকেও কিছু ক্ষতি মেনে নিতে হবে।
তথ্যসূত্র: অ্যাপল ইনসাইডার, ফোর্বস, ব্লুমবার্গ,স্পুতনিক নিউজ ও ওয়্যারড